শরীফ-এরিকোর ২ সন্তানকে ডেকেছে আপিল বিভাগ

বাংলাদেশের নাগরিক ইমরান শরীফ এবং জাপানের নাগরিক নাকানো এরিকোর দুই শিশু সন্তানকে ডেকেছে সর্বোচ্চ আদালত।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Dec 2021, 02:00 PM
Updated : 12 Dec 2021, 02:00 PM

আগামী বুধবার তাদের নিয়ে আসতে বলে সে পর্যন্ত শিশুদের মায়ের জিম্মায় দিয়েছে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।

শিশুদের বাবা ইমরান শরীফের জিম্মায় দিয়ে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নাকানো এরিকোর আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর রোববার এ আদেশ হয়। 

আদালতে নাকানো এরিকোর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আহসানুল করিম, সঙ্গে ছিলেন মোহাম্মদ শিশির মনির। ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

আহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, “১১ বছর ও ৯ বছরের দুই মেয়ে বাবার কাছে থাকবে, না মায়ের কাছে- সে প্রশ্নে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, মেয়েরা বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মা-ই হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।

“আজকে আপিল বিভাগ আমাদের কথা শুনেছেন। শোনার পর আদেশে বলেছেন, আজ রাত ১০টার মধ্যে মা যেখানে আছেন, সেখানে বাচ্চাদের পৌঁছে দিতে হবে। আগামী ১৫ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে আদালতের সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং পরে আদালত একটি আদেশ দেবেন।”

ভিনদেশী নাকানো এরিকো সন্তানদের স্বার্থে বাংলাদেশি ইমরানের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্কও চালিয়ে নিতে আগ্রহী বলে তার আইনজীবী জানান।

২০০৮ সালে বিয়ে করে জাপানে স্বামী ইমরানকে নিয়ে থাকা নাকানো এরিকো দাম্পত্য কলহের জেরে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন।

এরপর ইমরান স্কুলপড়ুয়া বড় দুই মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে জাপানে এরিকোর সঙ্গে থেকে যান।

মেয়েদের জিম্মা পেতে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশে আসেন এই জাপানি নারী।

তিনি হাই কোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলে বিচারক। কিন্তু সমঝোতা না হওয়ায় হাই কোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়, ঢাকায় নিয়ে আসা দুই মেয়ে তাদের বাবা ইমরান শরীফের কাছেই থাকবে। তবে মা সন্তানদের সঙ্গে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন।

গত ২১ নভেম্বর হাই কোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চের দেওয়া সে রায়ে বলা হয়, যেহেতু মা জাপানি নাগরিক এবং সেখানে বসবাস ও চাকরি করেন, সে কারণে তিনি তার সুবিধামতো সময়ে বাংলাদেশে এসে সন্তানদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন।

হাই কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের চেম্বার আদলতে আবেদন করেন শিশুদের মা নাকানো এরিকো। সেই আবেদনটির প্রাথমিক শুনানি হল আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে।

বাবা-মায়ের আইনি লড়াই

নাকানো এরিকো (৪৬) পেশায় চিকিৎসক; বাংলাদেশি নাগরিক শরীফ ইমরান  (৫৮) একজন প্রকৌশলী। তাদের পরিচয় হয় টোকিওর একটি হাসপাতালে, যা পরিণয়ে গড়ায় ২০০৮ সালের ১১ জুলাই।

আদালতের তথ্য অনুযায়ী, দুজনের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। দুজনের কেউই নিজ ধর্ম ত্যাগ করেননি।

টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন। তাদের বয়স যথাক্রমে ১১, ১০ ও ৭ বছর। তিন মেয়ে টোকিওর একটি স্কুলে পড়ত।

নাকানো ও ইমরান ২০২০ সাল পর্যন্ত একসঙ্গেই ছিলেন। দাম্পত্য কলহের জেরে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন এরিকো।

এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান টোকিওর ওই স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার এক মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন। তবে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ সেই আবেদন নাকচ করে।

পরে স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে এরিকোর ভাষ্য।

২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করলে এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। উল্টো সন্তানদের জিম্মা চেয়ে গত ২৮ জানুয়ারি টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন তিনি।

টোকিওর আদালত গত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেয়। তবে ওই আদেশ না মেনে ইমরান শরীফ শুধু একবার মায়ের সঙ্গে বড় দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন বলে এরিকো বাংলাদেশের হাই কোর্টে করা আবেদনে বলেছেন।

গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইমরান মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট গ্রহণ করার পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি।

এদিকে গত ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে বড় দুই মেয়ের জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়। দুই মেয়েকে ফিরে পেতে এরিকো বাংলাদেশে আসতে চাইলে বাধা হয় মহামারী। শেষ পর্যন্ত ১৮ জুলাই তিনি শ্রীলঙ্কা হয়ে ঢাকায় পৌঁছান।