আবরার হত্যার রায় পড়ছে আদালত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করছে আদালত

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2021, 06:12 AM
Updated : 8 Dec 2021, 06:12 AM

ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান বুধবার বেলা ১২টার দিকে আলোচিত এ মামলার রায় পড়া শুরু করেন।

এ মামলার ২৫ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ২২ জনকে সকালেই আদালতে হাজির করা হয়।

বুয়েটের শেরেবাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট। ওই শিক্ষায়তনে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।

আবরারের বাবা, এ মামলার বাদী বরকত উল্লাহও রায় জানতে উপস্থিত রয়েছেন আদালতে। তিনি বলেছেন, একটি দৃষ্টন্তমূলক রায় হোক, যাতে আর কোনো বাবা-মায়ের বুক খালি না হয়- এটুকুই তার প্রত্যাশা।

রায়ের আগের দিন মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখানো শেষ রাতে ঘুম ভেঙে যায়, ছেলেটার কথা মনে পড়ে। সারাজীবনই মনে পড়বে। ”

ভারী হয়ে আসা কণ্ঠে বরকতুল্লাহ বলেন, “আমার ছেলেটা কখনো শিবির করেনি। অথচ ওকে শিবির বলে পিটিয়ে মারল।”

এ মামলায় অভিযুক্ত ২৫ আসামির সবাই বুয়েটের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী। তাদের তিনজনকে পলাতক দেখিয়ে এ মামলার বিচার চলে।

আবরার ফাহাদ

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলা বিচারে এসেছিল। দুই পক্ষে যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে গত ১৪ নভেম্বর বিচারক এ মামলার রায়ের জন্য ২৮ নভেম্বর তারিখ রেখেছিলেন।

কিন্তু আরও কিছু ‘সময় দরকার’ জানিয়ে সেদিন রায় পিছিয়ে ৮ ডিসেম্বর নতুন তারিখ রাখেন বিচারক।

আবরারের বাবা বলেন, “আদালতের প্রতি আমাদের পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা আছে।...  রায়ে সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি।  কেউ যেন মামলা থেকে খালাস না পায়। রায়টি যেন দৃষ্টন্তমূলক হয়। আর যেন আমার মত কোনো বাবা মায়ের বুক খালি না হয়।”

আবরারের মামা মোফাজ্জল হোসেন থাকেন ঢাকার রামপুরায়। রায়ে আগের দিনও তিনি আফসোস করছিলেন ভাগ্নের বিপদে পড়ার খবর সময়মত না পাওয়ার জন্য। 

“যদি নির্যাতনের ঘটনাটা জানতাম, যদি শুধু একটা ফোন পেতাম, তাহলেও সেদিন  হলে চলে  যেতে পারতাম। আবরারকে বাঁচাতে পারতাম।”

মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “আমরা  প্রত্যাশা করি রায় যেন আর না পেছায়। রায়ে  যেন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড হয়। দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে কেউ আর এ ধরনের জঘণ্য অপরাধ করতে সাহস পাবে না।”

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ের তারিখ থাকায় রোববার সকালে আদালতে উপস্থিত হন এ মামলার বাদী আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। তবে এদিন রায় হয়নি। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

 

আবরার হত্যায় অভিযুক্ত যারা

এজাহারের ১৯ আসামি: বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ), এ এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ) ।

এজাহারের বাইরের ৬ আসামি: বুয়েট ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।

পলাতক ৩ জন: এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) এবং মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল)।

‘স্বীকারোক্তি’ দিয়েছেন ৮ জন: মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, এ এস এম নাজমুস সাদাত এবং খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম তানভীর।

মারপিটে সরাসরি জড়িত ১১ জন: মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মনিরুজ্জামান মনির, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম এবং খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম তানভীর।

ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত ১১ জন: মেহেদী হাসান রাসেল, মুহতাসিম ফুয়াদ, মেহেদী হাসান রবিন, অনিক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মনিরুজ্জামান মনির, ইফতি মোশাররফ সকাল, মুনতাসির আল জেমি, এহতেশামুল রাব্বি তানিম, মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ এবং মুজতবা রাফিদ।

মামলা বৃত্তান্ত

আবরারকে যে রাতে হত্যা করা হয়, তার পরদিন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে।

পাঁচ সপ্তাহ তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ওইবছর ১৩ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেখানে আসামি করা হয় মোট ২৫ জনকে।

অভিযোগপত্র গ্রহণ করে গত ১৮ নভেম্বর পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তাদের মধ্যে একজন পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে মামলাটি পরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ স্থানান্তর করে আদেশ জারি হয়। বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

গত বছরের  ৫ অক্টোবর এ মামলার বাদী ও আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ আদালতে সাক্ষ্য দেন। এর মধ্য দিয়ে এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। কারাগারে থাকা ২২ আসামি গত ১৪ সেপ্টেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থনে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তিন আসামি পলাতক থাকায় তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি।

এরপর কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এ মামলার চার্জ গঠনের সময় শব্দগত ত্রুটি থাকায় ৭ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষ তা সংশোধনের আবেদন করে। পরদিন ২৫ আসামির বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযোগ গঠন করে আদালত।

আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করে। গত ২৪ অক্টোবর রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল যুক্তিতর্ক উপস্থাপনে পলাতক তিন আসামিসহ ২৫ জনের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন।

অন্যদিকে অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, এ মামলায় অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা’ রয়েছে, যার ফলে আসামিদের আটকানো ‘সম্ভব না’।

পুরনো খবর