‘অর্থ পাচারে’ নাম এসেছে যাদের, তাদের নিয়ে পদক্ষেপ কী: হাই কোর্ট

কর ফাঁকি সংক্রান্ত পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থার পদক্ষেপ জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Dec 2021, 12:15 PM
Updated : 6 Dec 2021, 01:04 PM

সেই সঙ্গে দেশে অর্থপাচার প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।  

এজন্য বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) আগামী ৯ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে উচ্চ আদালত।  

বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাই কোর্ট বেঞ্চ সোমবার এই আদেশ দেয়।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক।

কাইয়ুম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে উঠে আসা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ জানতে চাওয়ার পাশাপাশি আদালত দুদকের কাছেও একটি বিষয় জানতে চেয়েছে।

“পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে ২০১৬ ও ২০২১ সালে দুদক বিএফআইইউতে দুটি চিঠি দিয়েছিল। ওই চিঠি দুটির প্রেক্ষিতে বিএফআইইউ কী জানিয়েছে বা আদৌ জানিয়েছিল কিনা, তার একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”

বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে- হাই কোর্ট জানতে চাওয়ার নয় মাস পর কর ফাঁকি সংক্রান্ত পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা দেশের ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকাসহ অর্থপাচার সংক্রান্ত প্রতিবেদন রোববার আদালতে উপস্থাপন করে দুদক।

এই ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৪টি নাম এসেছিল ‘পানামা পেপার্সে।’ আর ‘প্যারাডাইস পেপার্সে’ এসেছিল ২৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম।

পানামা পেপার্স সংক্রান্ত দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের বৈশ্বিক জোট ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)’র তথ্য বিশ্লেষণ, পর‌্যালোচনা করে পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে প্রথম পর্বে বাংলাদেশি ৪৩ ব্যক্তি ২টি প্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে ১৮ ব্যক্তি ও ৫টি প্রতিষ্ঠানসহ মোট ৬১ জন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে।

দুদক বলেছে, অনুসন্ধানের সময় এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিএফআইইউ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। দুদক এখনও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বিডিনিউ জেটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল আমরা পানামা এবং প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা অর্থ পাচারকারী ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দুটি তালিকা আদলতকে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে প্যারাডাইস পেপার্সের ২৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নাম ঠিক আছে।

“কিন্তু পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা মোট ৬১ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুদক ১৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকা কেন দিল তা জানতে চেয়েছিলেন আদালত। আমি বলেছি, কমিশনের সাথে কথা বলে বিষয়টি জানাতে হবে।”

পানামা পেপার্সে আসা ১৪ নাম

বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ফয়সাল আহমেদ চৌধুরী,সেতু কর্পোরেশনের পরিচালক উম্মে রুবানা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, গুলশান-২ এর আজমত  মঈন, বনানীর সালমা হক, এসএম জোবায়দুল হক, বারিধারার সৈয়দ সিরাজুল হক, ধানমন্ডির দিলীপ কুমার মোদি, শরীফ জহির, গুলশানের তারিক ইকরামুল হক, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, পরিচালক খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম, আহমেদ ইসমাইল হোসেন ও আখতার মাহমুদ।

প্যারাডাইস পেপার্সে আসা ২৯ নাম

বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও তার স্ত্রী নাসরিন ফাতেমা আউয়াল,ছেলে তাবিথ আউয়াল, তাফসির আউয়াল, তাজওয়ার মো. আউয়াল, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মোগল ফরিদা ওয়াই ও শহিদ উল্লাহ, ঢাকার বনানীর চৌধুরী ফয়সাল, বারিধারার আহমাদ সামির, ব্রামার অ্যান্ড পার্টনার্স অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড ও ভেনাস ওভারসিজ কোং-এর মুসা বিন শমসের,ডাইনামিক এনার্জির ফজলে এলাহী, ইন্ট্রিপিড গ্রুপের কেএইচ আসাদুল ইসলাম, খালেদা শিপিং কোম্পানির জুলফিকার আহমেদ, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের তাজুল ইসলাম তাজুল, চট্টগ্রামের বেঙ্গল শিপিং লাইনসের মোহাম্মদ মালেক, ঢাকার সাউদার্ন আইস শিপিং কোম্পানির শাহনাজ হুদা রাজ্জাক, ওসান আইস শিপিং কোম্পানির ইমরান রহমান, শামস শিপিং লিমিটিডের মোহাম্মদ এ আউয়াল, ঢাকার উত্তরার এরিক জনসন আনড্রেস উইলসন, ইন্ট্রিডিপ গ্রুপের ফারহান ইয়াকুবুর রহমান, জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের তাজুল ইসলাম, পদ্মা টেক্সটাইলের আমানুল্লাহ চাগলা, রাশিয়ার নিউটেকনোলজি ইনভেস্টমেন্টের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান, মাল্টার মোহাম্মদ রেজাউল হক, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মোহাম্মদ কামাল ভূঁইয়া, তুহিন-সুমন, সেলকন শিপিং কোম্পানির মাহতাবা রহমান, নারায়ণগঞ্জের জেমিকো ট্রেড ইন্টান্যাশনালের ফারুক পালওয়ান ও আয়ারল্যান্ডের গ্লোবাল এডুকেশন সিস্টেমের মাহমুদ হোসাইন।

আদালতের আদেশে এর আগে গত ২৪ অক্টোবর হাই কোর্টকে ঢাকা-চট্টগ্রামে তদন্তাধীন সাত মামলায় ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১০ কোটি ৮০ লক্ষ ৭৪৮ টাকা পাচারের তথ্য দিয়েছিল পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সে প্রতিবেদনে অর্থ পাচারকারী ব্যক্তির মধ্যে উঠে আসে যুবলীগের সাবেক (বহিস্কৃত) নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর এ কে এম মোমিনুল হক ওরফে সাঈদের নাম।

এসব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও দুবাইয়ে টাকা পাচার করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় সিআইডির প্রতিবেদনে।

সোমবার এ দুই প্রতিবেদনের ওপর শুনানির পর পদক্ষেপ জানতে চেয়ে আদেশ দিল হাই কোর্ট।  

বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস।

তার প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত রুলসহ আদেশ দেয়। সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে, সে তথ্য জানতে চায় হাই কোর্ট।

এছাড়া পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইস পেপার্সে বাংলাদেশি যেসব নাগরিক ও কোম্পানির নাম এসেছে, তাদের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না এবং সে তদন্তের অগ্রগতি প্রতি মাসে আদালতকে জানাতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।

এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল গত বছরের ১৮ নভেম্বর ডিআরইউর মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের সত্যতা পাওয়ার কথা বলার পর।

তার বক্তব্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বাঙালি অধ্যুষিত কানাডার কথিত ‘বেগম পাড়ার’ প্রসঙ্গ উঠে আসে।

সেসব প্রতিবেদন নজরে আসার পর গত বছর ২২ নভেম্বর হাই কোর্ট অর্থপাচারকারী দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানা চাওয়ার পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা, তা জানতে চায় হাই কোর্ট।

এর মধ্যেই বিদেশি ব্যাংক, বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টে এ রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস।

এখন দুটি বিষয়ের এক সঙ্গে শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে।