বিশ্ব সহযোগিতার পথের কাঁটা পরাশক্তির উত্তেজনা: বান কি-মুন

পরাশক্তির উত্তেজনা ও আঞ্চলিক সংঘাত বাড়তে থাকায় চরম প্রয়োজনের মুহূর্তেও বিশ্ব সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2021, 02:51 PM
Updated : 4 Dec 2021, 02:57 PM

শনিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও ভাষণে একথা বলেন তিনি।

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরতে গিয়ে বান কি-মুন বলেন, পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ও আঞ্চলিক সংঘাত বাড়তে থাকায় চরম প্রয়োজনের মুহূর্তেও বিশ্ব সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

প্যানেল আলোচনা ও অন্যান্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সকালে দুদিনের শান্তি সম্মেলন শুরু হয়। বিকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

অনুষ্ঠানে পাঠানো ভিডিওবার্তায় বৈষম্যহীনভাবে চলমান কোভিড মহামারী মোকাবেলায় বিশ্ব নেতাদের উদ্যোগও কামনা করেন বান কি-মুন।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক টিকাদান কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করার জন্য আমাদের উদ্যোগ বাড়াতে হবে এবং মহামারী থেকে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত পুনরুদ্ধার কার্যক্রম নিতে হবে।

কোভিড মহামারী থেকে পুনরুদ্ধার দীর্ঘ ও পরিশ্রমসাধ্য হবে মন্তব্য করে বান কি-মুন বলেন, বিশেষ করে, যখন অনেকের জন্য টিকার ক্ষেত্রে অসাম্য বিরাজ করছে।

“দ্রুত সময়ে পুননির্মাণের জন্য কেবল আগের অবস্থায় ফিরে আসা নয়, এর সঙ্গে দরকার পরিবেশসম্মত, টেকসই ও সমন্বিতভাবে ফিরে আসা। এজন্য টিকার বৈষম্য আমাদের দূর করতেই হবে।”

তিনি বলেন, বৈশ্বিক পুনরুদ্ধার কেবল শ্লথই নয়, এটা বড় রকমের বৈষম্যমূলকও। এজন্য আমাদেরকে কেবল বহুমুখী আন্তর্জাতিক ‍উদ্যোগ নিলে হবে না, মহামারী পরবর্তী শান্তিপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিরাজমান রাখার জন্যও কাজ করতে হবে।”

করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলার পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায়ও এক যোগে কাজ করার আহ্বান জানান জাতিসংঘের সাবেক এই মহাসচিব।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সমস্যার বৈশ্বিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। এই সমাধান হতে হবে সহযোগিতামূলক, অংশীদারী ও সংহতির। কারণ পরস্পর সংযুক্ত বিশ্বে কোনো দেশই বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়।

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে মালয়েশিয়ার সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ হামিদ আলবার বলেন, এই অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরানো প্রয়োজন। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে তাদের প্রত্যাবাসনে বাধ্য করতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে হবে।

বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় কাজ করতে জাতিসংঘকে ঢেলে সাজাতে হবে মনে বলে মনে করেন মিশরের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আরব লীগের সাবেক মহাসচিব আমর মুসা।

তিনি বলেন, “জাতিসংঘ মানেই ব্যর্থতা নয়। তার সফলতার মূলে রয়েছে তার বিশেষ সংস্থাগুলো, যারা মানুষের অনেক ধরনের কাজ করেছে। তবে রাজনৈতিক দিক থেকে ব্যর্থতা অবশ্যই আছে জাতিসংঘের। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের, এমনকি সাধারণ পরিষদেরও।

“আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে সংস্থার এই দুই অঙ্গের পুনর্নিমাণ জরুরি। কারণ, বৈশ্বিক কর্মধারা ও মানুষের জীবন অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”

কোভিড মহামারীকে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিবের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “তার মানে শান্তি ও নিরাপত্তার বর্তমান সংজ্ঞাকে পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। মানবতার জন্য হুমকি বড় ধরনের মতানৈক্যের বিষয় কোনোভাবে হতে পারে না।”

অনুষ্ঠানে ভারতের সাবেক মন্ত্রী সুরেশ প্রভাকর প্রভু বলেন, সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে শান্তি কোনোভাবে আসবে না। ক্ষুধার্তকে শান্তির বাণী শুনিয়ে কোনো লাভ নেই।

শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব কার্যক্রম দরকার, তার ঘাটতি দূর করতে সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় থেকেও ভূমিকা রাখা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে বিশ্ব এখনো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসছে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, মানবাধিকারের মূল্যবোধ ও গণতন্ত্র কি বিশ্বকে আরও শান্তিপূর্ণ করতে পারবে?

“কারণ এর মধ্যে জাতীয়তাবাদ, কর্তৃত্ববাদ, বর্ণবাদ, সন্ত্রাসবাদ, পরমাণু অস্ত্রের বিস্তারের মতো বিষয় রয়েছে। যেগুলো সন্ত্রাসবাদের দিকে ধাবিত করছে, যুদ্ধ বাঁধাচ্ছে আর বিনষ্ট করছে শান্তি।”

এমতবাবস্থায় টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার কীভাবে কাজ করতে হবে, সেটা নতুনভাবে চিন্তা করা উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সংঘাত বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা্‌ আমাদের দরকার। এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, তাকে ১৯৭৩ সালে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।

“আমরা কেউ সংঘাত ও বলপ্রয়োগ একা বন্ধ করতে পারব না। আমাদের এক হতে হবে এবং সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব নিয়ে একসাথে পথ চলতে হবে, জাতিতে জাতিতে ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর করার জন্য।”

অন্যদের মধ্যে জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আনওয়ারুল করিম চৌধুরী, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।