কর্মকর্তাদের ‘কাল্পনিক’ বিদেশ ভ্রমণ বন্ধে হাই কোর্টের তিন নির্দেশনা

সরকারি কর্মকর্তাদের ‘কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যহীন’ বিদেশ ভ্রমণ এবং জনগণের টাকার অপচয় বন্ধে তিন নির্দেশনা এসেছে হাই কোর্টের এক রায়ের পর্যবেক্ষণে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2021, 05:32 AM
Updated : 2 Dec 2021, 05:32 AM

হাই কোর্ট বলেছে, অতিরিক্ত সচিব তার নিচের পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তাদের সরকারি সফর বা ভ্রমণে বিদেশে যাওয়ার আগে কেবল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও অনুমতি নিতে হবে।

এসব দপ্তর থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যেতে পারবেন না। সফর শেষে দেশে ফিরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে সফরের ব্যয় ও বিশদ বর্ণনা দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন দিতে হবে।

এক রিট মামলার বিচার শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাই কোর্টের দেওয়া রায়ে এই তিন নির্দেশনা আসে। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

এ মামলার বিচার করতে গিয়ে জানা যায়, ফেরির জন্য সার্চ ও ফগলাইট কেনার আগে তা পরখ করতে বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন বিআইডব্লিউটিসির একদল কর্মকর্তা।

হাই কোর্ট বলেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের ‘পদের অপব্যবহার’ করেছেন এবং ‘চরম স্বেচ্ছাচারিতার’ পরিচয় দিয়ে জনগণের অর্থের অপচয় করেছেন। তাদের আচরণ ‘নব্য জমিদারের’ মত। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে উচ্চ আদালত এটা চলতে দিতে পারে না।

১৪ পৃষ্ঠার রায়টি লিখেছেন বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী। বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক কাজী জিনাত হক তাতে একমত প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) এক চিঠির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সার্চ অ্যান্ড ফগলাইট সরবরাহকারী কোম্পানি জনি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী ওমর আলী ২০১৬ সালে এই রিট মামলা করেন।

প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট সে সময় রুল দেয়। পরে চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুলটি খারিজ করে রায় দেয় উচ্চ আদালত।

আরিচা ও মাওয়ায় বিআইডব্লিউটিসি ফেরিতে সার্চ ও ফগলাইট বসাতে ২০১৫ সালে দরপত্র ডেকেছিল বিআইডব্লিউটিসি। সেই কাজ পেয়েছিল জনি করপোরেশন।

তার আগে প্রি শিপমেন্ট দেখার জন্য বিআইডব্লিউটিসির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যায়। ১০টি ফগলাইটের জন্য ছয় কোটি টাকার ওই কাজে ব্যাংক গ্যারান্টি ছিল ২৮ লাখ টাকা।

চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করার অভিযোগে ব্যাংক গ্যারান্টি অর্থ নগদায়নের জন্য বিআইডব্লিউটিসি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে চিঠি দিলে জনি করপোরেশন হাই কোর্টে এই রিট করে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান, সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অবন্তী নূরুল। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বাহাদুর সাহা। আর বিআইডব্লিউটিসির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সাইফুর রশীদ।

সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ ‘নব্য জমিদারের’ মত

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, দাপ্তরিক কাজে বা বিভিন্ন প্রয়োজনে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ করতে হয়। সেখানে জনগণের অর্থ যাতে অপচয় বা নষ্ট না হয়, তা নিশ্চিত করা সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে এ আদালতের ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’।

এ রিট মামলার উদাহরণ দিয়ে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “এখানে সরকারি কর্মকর্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণের জন্য কেবল তাদের সরকারি অবস্থান এবং কর্তৃত্বের অপব্যবহারই করেননি, তারা তাদের দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়েছেন।”

আদালত বলেছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সার্বিক অদক্ষতার কারণে ফগ লাইটের গুণগত মান ও কার্যকারিতা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ফগ লাইট প্রয়োজন হয় শীত কালে। অথচ ‘যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে’ তারা জুন মাসে ওই লাইট পরীক্ষা করেছিলেন।

“সরকারি দায়িত্বশীলরা যদি এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন হন, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ক্ষতি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কেবল তাদের পদের অপব্যবহারই করেননি, তারা তাদের অযোগ্যতা স্বীকর না করে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন।” 

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জনগণের অর্থ অপচয়ের বিষয়টি বাদ দিলেও একটি বিষয় উপেক্ষা করার সুযোগ নেই যে, শীতকালে ফগ লাইটগুলো কাজে না লাগায় শত শত সাধারণ যাত্রীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে।

 “১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ নব্য জমিদারের মত।”

সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বা ভ্রমণ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি আলোচিত খবরের কথাও এসেছে এ রায়ের পর্যবেক্ষণে।

“সম্প্রতি বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, স্কুলে ‘মিড-ডে মিল’ ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য পাঁচ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরের মধ্যে পাঁচ শতাধিক সরকারি কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে।

“সৌভাগ্য যে, সরকার এ প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়নি। সরকারি কর্মকর্তাদের এ ধরনের আচরণ যদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে তাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে দেওয়ার অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয়।”

আদালত বলেছে, “আমাদের খুব শীঘ্রই দেখতে হতে পারে যে, সরকারি কর্মকর্তারা ফরমাল স্যুট পরা শিখতে যুক্তরাজ্যে যাচ্ছেন। বিষয়টি অযৌক্তিক শোনালেও শীঘ্রই তা বাস্তবে পরিণত হতে পারে।”

সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দিয়ে আদলত পর্যবেক্ষণে বলেছে, “সরকারি কর্মকর্তাদের মনে রাখতে হবে, কোনো অনিশ্চিত শর্তে নয়, জনগণের সেবা করার জন্য তাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাও জনগণের টাকায়।

“প্রত্যেক সরকারি কর্মকর্তার নৈতিক দায়িত্ব ও বাধ্যবাধকতা হচ্ছে, জনগণের সেবা করা। তাছাড়া এটি শুধু কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতা নয়, সংবিধান ও বিভিন্ন আইন দ্বারা সরকারি কর্মকর্তাদের পরিষেবা নিয়ন্ত্রিত।”

আদালত বলেছে, “সরকারি কর্মকর্তাদের এটি মাথায় রাখতে হবে যে, তারা বিনামূল্যে স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন না; বরং, তারা দায়িত্বশীল পদে থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন বা করেন, তার জন্য জনগণ টাকা দিচ্ছে।

“জনগণের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয় এমন বেপরোয়া ও স্বেচ্ছাচারীভাবে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের কোনো অধিকার তাদের নেই। আইন, বিধি ও অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাসাপেক্ষ।”

যুক্তরাজ্যের ‘সিভিল সার্ভিস কোড’ থেকে উদ্ধৃত করে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারি কর্মকর্তাদের নৈতিক মানদণ্ড বজায় রাখার জন্য ওই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়ছিল।

“যেখানে এটি নির্ধারিত ছিল যে সরকারি কর্মকর্তাদের অন্যান্য যে কোনো বিষয়ের মধ্যে জনসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সহানুভূতিশীলতার সাথে কার্যকরভাবে এবং পক্ষপাতহীনভাবে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।

“ওই সিভিল সার্ভিস কোডে আরও বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের অর্থের সঠিক, কার্যকর এবং সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রচেষ্টা থাকা উচিত।”

হাই কোর্ট বলেছে, সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে এ আদালত সরকারি কর্মকর্তাদের ‘এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ’ চলতে দিতে পারে না।

সে কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের দাপ্তরিক কজে বিদেশ ভ্রমণ বা সফরের একটি নীতিমালা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে রায়ে।

নির্দেশনা

# সব ধরনের সরকারি ভ্রমণ বা সফরের আগে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার এবং তার নিচের সরকারি কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও অনুমতি নিতে হবে।

# ফিরে আসার পর, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কছে সফরের ব্যয় ও বিশদ বিবরণসহ প্রতিবেদন দিতে হবে।

# প্রতিটি মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে যাতে কোনো সরকারি সফরে যেতে দেওয়া না হয়।

এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘কাল্পনিক ও উদ্দেশ্যহীন’ বিদেশ ভ্রমণ এবং জনগণের টাকার অপচয় রোধ করা যাবে বলে অভিমত দিয়েছে উচ্চ আদালত।