স্কুলে হাসিখুশি মাঈনউদ্দিন এখন কেবলই ছবি

কষ্টের সংসারে বেড়ে ওঠা মো. মাঈনউদ্দিনকে স্কুলে হাসিখুশি মেজাজেই দেখে আসছিলেন তার শিক্ষকরা, সড়কে তার এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না তারা।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Nov 2021, 05:09 PM
Updated : 30 Nov 2021, 05:09 PM

ঢাকার রামপুরা একরামুন্নছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১৫৯ শিক্ষার্থী, তাদের একজন মাঈনউদ্দিন সোমবার সড়কে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান।

“মাঈনউদ্দিন ছিল হাসিখুশি প্রকৃতির, কারও সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখিনি,” নিজের ছাত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন তার সরাসরি শিক্ষক সামসুন্নাহার রানু।

মঙ্গলবার একরামুন্নছা উচ্চ বিদ্যালয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা হয় ইংরেজি বিষয়ের এই শিক্ষকের সঙ্গে।

রানু বলেন, “সে (মাঈনউদ্দিন) ছিল নিয়মিত ছাত্র। একটু চঞ্চল প্রকৃতির ছিল, বন্ধুদের সাথে মজার ছলে মাঝেমাঝে দুষ্টামি করত, কিন্তু বেয়াদব ছিল না।”

হিসাব বিজ্ঞানের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম ছিলেন মাঈনউদ্দিনের ক্লাস শিক্ষক।

তিনি বলেন, “ওদের ক্লাস শেষে বেশ কয়েকজন ছাত্রের সাথে সেও আমার কাছে প্রাইভেট পড়ত। গত ২২ নভেম্বর বিকেলে সে আমার কাছে শেষ পড়া পড়েছে।

“এই মর্মান্তিক ঘটনা প্রিয় ছাত্রটির জীবটাই কেড়ে নিয়েছে। এটা আমরা কখনও প্রত্যাশা করি না। তা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না।”

সড়কে বাসের চাপায় নিহত ছেলে মো. মাঈনউদ্দিনের লাশ জানাজার জন্য নেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বড় ভাই। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

সোমবার মাঈনউদ্দিনের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল তার শিক্ষক সাইফুলের।

“গতকাল সে আমার সাথে মোবাইলে কথা বলেছে, আজকে আমাকে বেতন দেওয়ার কথা জানিয়েছিল সে। বলেছিল- তার মা বেতনের টাকাটা রেডি করে রেখেছে, ৩০ তারিখ আজকে সে দিয়ে যাবে, সেই কথাও জানিয়েছিল।”

সোমবার রাত ১০টার দিকে ডিআইটি রোড পূর্ব রামপুরা লাজ ফার্মার সামনে গ্রিন অনাবিল পরিবহনের একটি বাসের চাপায় পিষে যায় মাঈনউদ্দিনের দেহ। আরও কয়েকজনের সঙ্গে রাস্তা পার হচ্ছিলেন এই তরুণ।

মাঈনউদ্দিন থাকতেন পূর্ব রামপুরা তিতাস রোডে ভাড়া বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে। তার বাবা আব্দুর রহমান ভান্ডারি একটি চায়ের দোকান চালান।

অনটনের সংসারে দুই ভাই আর এক বাক প্রতিবন্ধী বোনের মধ্যে মাঈনউদ্দিন ছিল সবার ছোট। তার বড় ভাই বনশ্রীর এক ব্যক্তির গাড়িচালক।

মাঈনউদ্দিনের অভাবের সংসারের কথা তুলে ধরে শিক্ষক সাইফুল বলেন, “ছেলেটিকে অনেক কষ্ট করে তার পরিবার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই পরিবারের দিকে সমাজের বিত্তবানদের একটু এগিয়ে আসলে পরিবারটির কষ্ট কিছুটা হলেও দূর হত।”

সড়কে বাসের চাপায় নিহত ছেলে মো. মাঈনউদ্দিনের লাশ জানাজার জন্য নেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা আব্দুর রহমান ভাণ্ডারী। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

মাঈনউদ্দিনের ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ ছিলেন এবং তিনি সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করতে বলে জানিয়েছেন তার শিক্ষক সাইফুল।

স্কুল থেকে কয়েকশ মিটারের মধ্যে মাঈনউদ্দিনের মৃত্যুর পর মঙ্গলবার সকালে তার বাড়িতে যান একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান হাওলাদার, কয়েকজন শিক্ষকও তার সঙ্গে ছিলেন।

মিজানুর বলেন, “ছেলেটির পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার আসলে কোনো ভাষা নেই। তার মা-বাবাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছি। তারা ছেলেকে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়েছে।”

তিনি বলেন, “যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা এখনও আমাদেরই ছাত্র। যারা পরীক্ষা দিয়ে আগেও পাস করে চলে গেছে, তারাও আমাদের ছাত্র, কারণ শিক্ষকের কাছে ছাত্র কখনও সাবেক হয় না, ছাত্র আজীবন শিক্ষকের কাছে ছাত্রই থাকে।”

মাঈনউদ্দিনের জন্ম দিন ছিল সোমবার, সেদিনই তার মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পরই তার মা রাশেদা বেগম তা মনে করতে পেরেছিলেন।

বাসে অর্ধেক ভাড়া ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে মারা যান মাঈনউদ্দিন, অথচ তিনি নিজেও এই আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।

মাঈনউদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় ‘বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত’ মৃত্যু সংঘটনের অভিযোগে চালকের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে রামপুরা থানায় একটি মামলা করেছেন তার মা রাশেদা বেগম।