সাবেক এই সহকর্মীকে হারিয়ে স্মৃতিকাতর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বললেন তাদের তারুণ্যের সেই দিনগুলোর কথা, যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, আর রফিকুল ইসলাম বাংলা বিভাগের। মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তখন উত্তাল।
“রফিকুল ইসলাম খুব সংস্কৃতিমনা ছিলেন। সাহিত্য, নাটক, আবৃত্তি- সাংস্কৃতিক যে কোনো কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন। প্রথম জীবনে তার একটা শখ ছিল ফটোগ্রাফি।
“১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় দেশে যখন তেমন উন্নত ক্যামেরা ছিল না, তখন তিনি এমন কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র তুলেছিলেন, যা পরে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পেয়েছে জাতি। এ ধরনের আলোকচিত্র অন্য কেউ তুলতে পারেনি।”
ভাষা সংগ্রামী রফিকুল ইসলাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিসাক্ষী। বাংলাদেশ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, তিনি ছিলেন সেই উদযাপনের জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি।
ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় মারা যান বাংলা একাডেমির সভাপতি রফিকুল ইসলাম। স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই নজরুল গবেষকের বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
ফেলে আসা বছরগুলোতে কাছ থেকে দেখা রফিকুল ইসলামের কথা স্মরণ করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “আমরা একসাথেই এই শহরে বড় হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বছর পাস করেছি এবং একই সময়ে শিক্ষকতা শুরু করেছি। দীর্ঘ সময় প্রতিবেশীও ছিলাম।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে ভাষার দাবিতে ছাত্রছাত্রীদের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রস্তুতির এই ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়া শেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চতর ডিগ্রি নেন রফিকুল ইসলাম।কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসার টানেই আবার দেশে ফিরে এসেছিলেন।
সে কথা তুলে ধরে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “দেশকে তিনি অনেক ভালোবাসতেন। আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে দেশে চলে এলেন। দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন।"
এক সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা রফিকুল ইসলাম এ বছর মে মাসে বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পান। আমৃত্যু তিনি সেই দায়িত্বে ছিলেন।
একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা তাকে স্মরণ করেছেন বাংলা একাডেমি পরিবারের ‘একান্ত আপনজন’ হিসেবে।
এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, “অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন অসাধারণ গবেষক। মহান ভাষা-আন্দোলনে তার ভূমিকা ঐতিহাসিক।… বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ চর্চা, ঢাকার ইতিহাস রচনা, মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা, নজরুল গবেষণা এবং বঙ্গবন্ধু-চর্চায় তার ভূমিকা অনন্যসাধারণ।”
বাংলা একাডেমি প্রণীত ও প্রকাশিত প্রমিত বাংলাভাষার ব্যাকরণের অন্যতম সম্পাদক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত নজরুল রচনাবলী জন্মশতবর্ষ সংস্করণের সম্পাদনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
কবি নূরুল হুদা বলেন, “তার প্রয়াণে বাংলা একাডেমি পরিবার শোকস্তব্ধ। ”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান তার শোকবার্তায় বলেন, ড. রফিকুল ইসলাম ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনার একজন ‘অসাধারণ ব্যক্তিত্ব’।
“জাতির যে কোনো সঙ্কটকালে ও দুর্যোগময় মুহূর্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশের আন্দোলনে অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম ছিলেন সামনের সারির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে ক্ষতি হল, তা কখনোই পূরণীয় নয়। দেশের শিক্ষা, শিল্প ও সাহিত্য অঙ্গনে অনন্য অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।"
আরও পড়ুন