ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পর্যন্ত বাংলাদেশের বন্ধুর পথ পরিক্রমার অগ্নিসাক্ষী, জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আর নেই।
Published : 30 Nov 2021, 02:48 PM
শিক্ষক, গুরুজন ও অভিভাবককে হারালাম: প্রধানমন্ত্রী
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে রফিকুল ইসলামের অবদান জাতি স্মরণ করবে: রাষ্ট্রপতি
ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় তার মৃত্যু হয় বলে তার ছেলে বর্ষণ ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিক্ষক, গবেষকের বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
তার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “বাংলাদেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তার অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।”
আর গত শতকের ষাটের দশকে রফিকুল ইসলামকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে পাওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তার ‘গুরুজন ও অভিভাবককে’ হারানোর কষ্টের কথা।
শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, “বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমার প্রিয় শিক্ষকের উৎসাহ ও প্রেরণা আমাকে সাহস জুগিয়েছে এবং এগিয়ে যেতে শক্তি দিয়েছে।”
উন্নত চিকিৎসার জন্য পরিবারের সদস্যরা রফিকুল ইসলামকে ভারতে নিয়ে যেতে চাইলেও তিনি রাজি হননি। অবস্থার অবনতি হলে তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়।
তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টায় গত ২৫ নভেম্বর কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার বিকালে সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
বর্ষণ জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তার বাবার মরদেহ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হবে উত্তরার বাসায়। সেখানে ১০ নম্বর সেক্টরের খালিদ বিন ওয়ালিদ মসজিদে এশার পর এক দফা জানাজা হবে। রাতে মরদেহ রাখা হবে হাসপাতালের হিমঘরে।
সবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বুধবার দুপুরে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের কফিন নিয়ে যাওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। আসরের পর জনাজা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
বর্ষণ বলেন, “আজিমপুরে আমাদের দাদার কবরে দাফন করার জন্যে আগেই বলে গেছেন বাবা।”
১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর উপজেলার কলাকান্দা গ্রামে রফিকুল ইসলামের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেখাপড়া শেষে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বে উচ্চশিক্ষা নেন।
তিনিই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক।
ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেওয়া রফিকুল ইসলাম সেই সময়ের দুর্লভ আলোকচিত্র ধারণ করেছেন নিজের ক্যামেরায়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে হয়েছেন নির্যাতিত। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের এই প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেইসব ইতিহাস গ্রন্থিত করে গেছেন তার লেখায়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রথম গ্রন্থ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থটিসহ প্রায় ৩০টি বই তার হাত দিয়েই পেয়েছে বাংলাদেশ।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য রফিকুল ইসলাম ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসেরও উপাচার্য ছিলেন। ২০১৮ সালে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপক করে নেয়।
এক সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা রফিকুল ইসলামকে গত ১৮ মে বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিল সরকার। আমৃত্যু তিনি সেই দায়িত্বে ছিলেন।
মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারে অবদান রাখায় এ বছর তাকে প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতা ও একুশে পদক পাওয়া শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক ড. রফিকুল ইসলাম বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও নজরুল একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মৃত্যুতে কমিটির পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, “তিনি জাতির পিতার আদর্শ ও চেতনাকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতেন। তার জীবন ও সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যত প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করবে।”