মহামারী বাজিয়েছে ছুটির ঘণ্টা

মহামারীর মধ্যে দিনমজুর বাবার উপার্জন কমে যাওয়ায় ঢাকায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়েছে নরসিংদীর বেলাব থানার নিলক্ষীয়ার রেশমা আক্তার। ফলে দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর এবার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2021, 06:57 PM
Updated : 28 Nov 2021, 06:57 PM

তার মা ফিরোজা বেগম বলছেন, আর সব অভিভাবকের মত তারাও মেয়েকে লেখাপড়া করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রেশমার বাবার রুটিরুজিতে ধাক্কা লাখায় তারা আর ‘কুলিয়ে উঠতে’ পারেননি।

ফিরোজা বললেন, “গরিবের মাইয়া পইড়া আর কি চাকরি পাইত? সুযোগ আইছে, সেইটা কাজে লাগাইছি। আমরার উপকারও হইতাছে। আর এহন কাজ রাইখা তো পরীক্ষাও দেওন যাইত না।”

রেশমার মত হাজারো শিক্ষার্থীর এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। বোর্ডগুলোর তালিকা মেলালে দেখা যায়, ঝরে পড়া এই শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অর্ধলক্ষের বেশি, যা মোট পরীক্ষার্থীর ২.১৫ শতাংশের মত।  

বোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল।

এমন যে হতে পারে, সে আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল। বিলম্বিত মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে অনুপস্থিতির এই হিসাব থেকে মহামারীতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশের ঝরে পড়ার চিত্রটা আরও একটু স্পষ্ট হল।  

আসনগুলো শূন্য ছিল

মহামারীতে নয় মাস পিছিয়ে গত ১৪ নভেম্বর প্রথম কোনো পাবলিক পরীক্ষায় বসে শিক্ষার্থীরা। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে তিনটি করে নৈর্বচনিক বিষয়ে এসএসসি ও সমমানের এই পরীক্ষা হয়। এ পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ করেছিল ২২ লাখ ২৭ হাজার শিক্ষার্থী।

প্রথম দিন ১১ বোর্ডের পদার্থবিজ্ঞান এবং কুরআন মজিদ ও তাজভিদ পরীক্ষায় ৯ লাখ ১২৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল ১৮ হাজার ৮২০ জন। তাদের মধ্যে ৩ হাজার ৫৪৮ জন নয় সাধারণ বোর্ডের, ৯ হাজার ৮৯৪ জন মাদ্রাসা বোর্ডের এবং ৫ হাজার ৩৭৮ জন কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থী ছিলেন।

পরদিন সাধারণ ৯ সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মানবিকের বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্ব সভ্যতা পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ১৭ হাজার ৭৩৩ জন। একই দিন বিকালে বাণিজ্য বিভাগের হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষায় অংশ নেয়নি ৫ হাজার ৮২০ জন।

১৮ নভেম্বর মাদ্রাসা বোর্ডের হাদিস শরিফের পরীক্ষায় অনুপস্থিতি ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। আর ২২ নভেম্বর মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়ের পরীক্ষায় ১১ বোর্ড মিলিয়ে অনুপস্থিত ছিল ৩১ হাজার ৯১০ জন।

এ বছর ঠিক কতজন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল তার সুনির্দিষ্ট হিসাব এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হাতে এখনও নেই। তবে বিষয়ভিত্তিক অনুপস্থিতির সংখ্যা হিসাব করলে মোট সংখ্যাটি ৫০ হাজারের বেশি হয়। 

মহামারীর আগে হয়ে যাওয়া ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিন ছিল বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা যা সব বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যই আবশ্যিক। সেদিন অনুপস্থিত ছিল ১২ হাজার ৯৩৭ জন শিক্ষার্থী। আর ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ১৪ হাজার ২৮ জন।

শিক্ষা বোর্ডগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই অনুপস্থিতির সংখ্যা এবার সবচেয়ে বেশি।

কারা ঝরে পড়ছে?

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের ইসলামপুরের আমেনা বেগম দারুল কুরআন দাখিল মাদ্রাসার কারিগরি শাখার এসএসসি ভোকেশনাল পরীক্ষায় এবার অনুপস্থিত ছিল প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী। এ প্রতিষ্ঠানের ৮০ জন পরীক্ষার্থীর ৪৩ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে।

মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোখলেসুর রহমান বললেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর অনুপস্থিতির হার ‘অনেক বেশি’।

তার মতে, মহামারীতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেকের জীবন বদলে গেছে। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় তাদের সামনে ‘সহজ সমাধান ছিল’ পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়া।

“যারা পরীক্ষা দেয়নি, তাদের কেউ বিদেশে চলে গেছে, কেউ চাকরি শুরু করেছে, মেয়েদের কারও কারও বিয়ে হয়ে গেছে।”

সিলেটের কানাইঘাট থানার ঘোড়াইগ্রামের আল হেরা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী প্রধান শিক্ষক জামালউদ্দিন চৌধুরী জানালেন, তাদের ৩৬ জন পরীক্ষার্থীর ১০ জনই অনুপস্থিত ছিল।

“করোনাকালে অনেকে ঝরে পড়েছে। দুই-একজন অমনোযোগী থাকার কারণে অংশ নিতে পারেনি। অনেকে কাজ শুরু করেছে। আমাদের এখানকার একজন দেশের বাইরে চলে গেছে। দুই-তিনজন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। অভিভাবকরাও বাচ্চাদের পড়াশুনার খবর রাখে না। তখন ঝরে পড়ে।”

নরসিংদীর বেলাব থানার দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বরাবরই শিক্ষার্থী উপস্থিতি সন্তোষজনক থাকে। তবে এবার ২৯৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ জন পরীক্ষায় বসেনি।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসলাম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "অন্যান্যবার আমাদের শতভাগ পরীক্ষার্থীই পরীক্ষায় অংশ নেয়। যারা পরীক্ষা দেবে না, তারা তো ফরমই পূরণ করে না। এবার কেউ চাকরিতে চলে গেছে, কেউ বিদেশে চলে গেছে, কারোর বিয়ে হয়ে গেছে।”

করোনাভাইরাস মহামারী গ্রাম পর্যায়ে শিক্ষায় যে ক্ষত তৈরি করেছে, এটি যে তারই চিত্র, তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই শিক্ষক।

“পরিবারের আয় রোজগার যখন কমে গেছে, তখন বাধ্য হয়ে তারা কাজে চলে গেছে৷ ওরা আর ফিরে আসেনি।”

শরিয়তপুরের গোসাইরহাটের ইদিলপুর সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্র তত্ত্বাবধারক মো. সাহাবুদ্দিন জানান, তাদের বিজ্ঞান ও বাণিজ্য শাখায় অনুপস্থিতি কম থাকলেও মানবিকে ২১ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয় নি। এই বিভাগে ৩৯১ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৩৭০ জন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মহামারী পরিস্থিতিতে অনেকে ভেবেছিল অটোপাস দেবে, কিন্তু যখন দেখল পরীক্ষা দিতে হবে; তখন আর কেন্দ্রে আসেনি।”

এর পিছনে অভিভাবকদের সচেতনতার ঘাটতিকেও দায় দিচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের অধ্যক্ষ মোখলেসুর রহমান।

তিনি বলেন, “পরীক্ষার্থীদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। আমাকে জানালে যদি ভেঙে দিই, সে কারণে আমাকে জানায়ওনি। পরে পরীক্ষা কেন দিল না, সেই খবর নিতে গিয়ে দেখলাম বিয়ে করে ওরা সংসার করছে।”

ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে রোববার সকালে এসএসসি পরীক্ষায় বসেছে শিক্ষার্থীরা। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কায়সার আহমেদ বলছেন, দাখিলে এবার  অনুপস্থিতি কেন বাড়ল, তার কারণ অনুসন্ধান করবেন তারা।

“কোন কারণে আসলে শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল, সেটা গতবারের তুলনায় কতটাণ বেশি... গত পাঁচ বছরের সঙ্গে তুলনা করে দেখা হবে। সমস্যাটা চিহ্নিত হলে সমাধান করা সহজ হবে।”

তিনি বলেন, দাখিলের পর এখন আলিম পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকায় সেই বিশ্লেষণের কাজটি করার সুযোগ হয়নি। পরীক্ষা শেষ হলে তারা দেখবেন। অধিদপ্তরও চেষ্টা করবে ‘ড্রপআউটের’ বিষয়টি বের করার।

কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আলী আকবর খান অনুপস্থিতি বাড়ার কারণ হিসেবে মহামারীর প্রভাবের কথাই বলছেন।

“অনেকে পড়াশোনা করে নাই। পরীক্ষা যে দিতে হবে, সেটা তারা আমলে নেয় নাই। মনে করছে, অটোপাস হবে। অনেকের প্রস্তুতি ভালো না। তারা পরের বছর হয়ত পরীক্ষা দেবেম এজন্য এবার দেয়নি।

“তাছাড়া গ্রামে তো অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, অনেকে কাজে ঢুকে পড়েছে; এগুলোও ফ্যাক্টর।”

এসব শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরতে ‘উৎসাহিত’ করা হবে জানিয়ে আলী আকবর বলেন, “আমরা বিভাগীয় কমিশনারদের সাথে আলোচনা করেছি। তাদের কারিগরি প্রতিষ্ঠানের দিকে দৃষ্টিপাত করতে বলেছি।”

নাটোরের বাগাতিপাড়া মহিলা মাদ্রাসা থেকে এবার দাখিলে পরীক্ষার্থী ছিল ১৫ জন; কিন্তু মহামারীর মধ্যে সবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর কেউ পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।

শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ

এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, সমাধান চাইলে সমস্যাগুলোকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দরকার।

“আমাদের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। পাস করে শিক্ষার্থীরা যে একটা ভালো চাকরি পাবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নাই। সে কারণে করোনায় ছোটখাটো কাজে তারা চলে গেছে।

“আবার সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা নাই। সে শঙ্কায় পরিবারগুলো মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। করোনাকালে ধর্ষণও তো বেড়ে গেছে।”

তার পরামর্শ, “কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। কর্মসংস্থান বাড়াতে জনমত গড়ে তুলতে হবে। না হলে কিশোর অপরাধের মত বিষয়গুলোও বাড়তে থাকবে।”

মহামারীতে অনেক প্রতিষ্ঠান বৃত্তি দেওয়া বন্ধ রেখেছে, এটাও ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।

“অনেক পরিবার অস্বচ্ছল হয়ে পড়েছে। মফস্বলে এটা বেশি। শহরের অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছে। তারা ভাবছে- সন্তানকে কাজে দেবে, নাকি পড়াশোনা করাবে।

“অনেক ছেলে-মেয়ে তো কাজে জড়িয়েও পড়েছে। তাদের চাকরির ওপর এখন সংসার নির্ভর করছে। ফলে সে চাকরি ছেড়ে পড়াশোনায় ফিরতে পারছে না। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অনেকে টিউশনি নির্ভর, হয়তো টাকার জন্য অনেকে টিউশন নিতে না পেরে পড়াই ছেড়ে দিয়েছে।”

দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যখন বন্ধ ছিল, অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চললেও অনেক শিক্ষার্থী এর বাইরে থেকে গেছে।

এই ডিজিটাল বৈষম্যকেও ঝরে পরার একটি কারণ হিসেবে দেখিয়ে মনজুরুল ইসলাম বলেন, “অনেক পরিবার প্রস্তুত হতে পারেনি। অনেক পরিবার ভেবেছে এক বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর পরীক্ষা দেবে।”

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এই শিক্ষক বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার একটি অনলাইন কোর্সে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছিল গ্রামের। তাদের ৪০ শতাংশের বেশি ক্লাসে যোগ দিতে পারেনি। তারা বলছে, ডেটা প্যাকেজের টাকা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”

অনুপস্থিতি বেশি হওয়ার সঙ্গে বাল্যবিয়ে ‘বেড়ে যাওয়ায়’ বিষয়টিও এবার সামনে আসছে। নাটোরের বাগাতিপাড়া মহিলা মাদ্রাসার একটি খবর সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। সেখানে ১৫ ছাত্রীর এবার দাখিল পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও মহামারীর মধ্যে সবার বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ আর পরীক্ষায় বসেনি।

মনজুরুল ইসলাম বলেন, “উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের তেমন সমস্যা হচ্ছে না। নিম্নবিত্ত ও গরিব পরিবারগুলো যেখানে আছে, সেখানেই সবচেয়ে বেশি অভাব এবং অনুপস্থিতির হার।”

শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের সরকার শিক্ষাবান্ধব না, এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাজেটের আগে কখনো কী শিক্ষাবিদ, শিক্ষকদের সাথে বসে?