অর্থপাচার নিয়ে দুদকের ক্ষমতা খুবই কম, বললেন কর্মকর্তারা

দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হলেও ‘এখতিয়ার’ হারিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Nov 2021, 04:07 PM
Updated : 21 Nov 2021, 04:38 PM

আগে সকল অর্থপাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও আইন সংশোধনের পর তা খুবই সীমিত হয় পড়েছে বলে জানান কমিশনের চেয়ারম্যানও।

রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির সপ্তদশ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন তারা।

‘অর্থপাচারের বিষয়ে দুদকের কিছু করার নেই’ জানিয়ে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, “মানি লন্ডারিংয়ের কাজটি এখন দুদকের না। অতিঅল্প একটু কাজ.. ২৬ ভাগের একভাগ কাজ। এটা আপনাদের সবাইকে বলতে হবে যে, মানি লন্ডারিংয়ের কাজটি সরকার আইন করে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে।

“আমরা দুদক জুরিসডিকশন দেখব। যা আমাদের জুরিসডিকশনে নেই সেটাতে আমরা যাব না। ওই বদনাম যেন আমাদের ঘাড়ে না আসে।”

২০১৫ সালে মুদ্রা পাচার আইন সংশোধন হলে সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তিদের অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ হারায় দুদক।

কমিশনার জহুরুল হক বলেন, “প্রাইভেট ব্যক্তি মানি লন্ডারিং করে এবং ব্যাপক পরিমাণে মানি লন্ডারিং করে। হাজার হাজার কোটি টাকা না, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং হয়। আমরা কী করব? আমরা তো কিছু করতে পারিনি।”

বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দুদক থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা থাকলেও আইনি কারণে সম্ভব নয় বলে জানালেন দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।

তিনি বলেন, “পূর্বে মানি লন্ডারিং বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনের। এখন এই সংক্রান্ত ২৮টি অপরাধের মধ্যে ২৭টিই চলে গেলে বিভিন্ন জায়গায়। একটি রয়ে গেছে দুদকের কাছে। এটা জানার অভাবে হয়ত…।”

২০১৫ সালে মুদ্রা পাচার আইন সংশোধনের ফলে কেবল ঘুষ ও দুর্নীতি সংক্রান্ত সরকারি কর্মীদের অর্থ পাচার অপরাধের তদন্তের ভার দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে থাকল। এর আগে মুদ্রাপাচারের ঘটনা তদন্তের সার্বিক দায়িত্ব ছিল দুদকের ওপর।

আইন সংশোধনের পর তা দুদকের পাশাপাশি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ কাস্টমস ও কর বিভাগ এবং মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তদন্তের সুযোগ পায়।

‘কেবল আইনের দ্বারা দুর্নীতি দমন দুরূহ’

দুর্নীতি দমন কমিশন ছোট-বড় সব দুর্নীতি সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকে বলে দাবি করেন দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ।

“শুধুমাত্র একটি আইনের ওপর নির্ভর করে দুর্নীতি দমন করাটা খুব দুরূহ এবং এতে করে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক দূরে থাকবে। এর জন্য সকলের অংশগ্রহণ লাগবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি মানুষ নিজের মধ্যে জাগরণ শুরু করলে দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে।”

দুর্নীতি প্রমাণ করা ‘অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটা পৃথিবীর সবদেশেই। আমাদের দেশে অভিযোগকেই মিথ্যা বলি। তিলকে তাল বলি। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেও মিথ্যা কথা বলে। সাক্ষীও সত্য কথা বলে না। তাহলে প্রমাণ করা অনেক কঠিন।”

তবে সমাজে জনশ্রুতি আছে এমন দুর্নীতিবাজকে বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছেন দুদক চেয়ারম্যান বলেন “জনশ্রুতি বলে একটি বিষয় আছে, আমরা সবাই জানি, অনেকে জানে যে, সে দুর্নীতিবাজ। কিন্তু আইন বা বিভিন্ন সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। তাদেরকে বর্জন করলেই হয়। আমি সবাইকে অনুরোধ করি, যে জনশ্রুতি আছে এমন দুর্নীতিবাজতে বর্জন করুন এবং চিহ্নিত করি।”

অন্যদিকে দুদক আইন মেনে কাজ করা হলে দুর্নীতি বন্ধ হবে বলে মনে করেন কমিশনার জহুরুল হক।

তিনি বলেন, “দুর্নীতি কীভাবে বন্ধ হবে তা আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে। দুদক আইন যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন আইন। আইন সঠিকভাবে মানেন দুর্নীতি বন্ধ হবে। মানতে হবে সাহসিকতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে এবং নিজের মনের জোর থাকতে হবে।”

দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং লোভী মানুষকে দিয়ে কখনও দুর্নীতি বন্ধ হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমি যদি লোভী হই, আমার মেরুদণ্ড থাকে দুর্বল। দুর্বল মেরুদণ্ড দিয়ে সবল কিছু আশা করা যায় না। আমাদের মেরুদণ্ড সবল কি না, এটুকু জেনে এখানে আসি।”

এদিকে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ‍দুদকের মামলার আসামি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে। এই বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যাখ্যা চাইতে সাংবাদিকদের পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “আসামি পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের কী করার আছে? আমরা যেগুলো মনে করি ঝুঁকিপূর্ণ আছে, তাদের বিদেশ গমন, একাউন্ট ফ্রিজ করার ব্যাপারে চিঠি জারি করে কোর্টে যাই। কোর্ট আমাদেরকে শতভাগ সহযোগিতা করে।

“কোর্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা কনফার্ম করে দেয়। আমরা বিভিন্ন জায়গায় চিঠি পাঠিয়ে দেই। এরপর কেউ পালিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের জিজ্ঞাসা না করে যেখান থেকে পালিয়ে যায়, ওখানে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বলে মনে করি।”

অনুষ্ঠানে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক খান, সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

একই অনুষ্ঠানে দুদক বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স এগেইনেস্ট করাপশন-র‌্যাকের পক্ষ থেকে টেলিভিশন, দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন ক্যাটাগরিতে তিনজনকে বেস্ট রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।