সেই বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ‘প্রয়োজনীয়’ ছিল: আইনমন্ত্রী

ধর্ষণের ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশকে মামলা না নেওয়ার পর্যবেক্ষণ দিয়ে সমালোচিত বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহারের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2021, 01:05 PM
Updated : 14 Nov 2021, 01:06 PM

তিনি বলেছেন, ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কামরুন্নাহার রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায় দিতে গিয়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা ‘মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি’।

“ব্যবস্থা গ্রহণটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটাও সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে কিন্তু এগিয়ে যাবে।”

ঢাকার সপ্তম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে তাকে আদালতে না বসার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

রোববার ওই আদেশে তাকে বর্তমান কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়কে।

বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সুপ্রিম কোর্টের চিঠি এখনও মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেনি। তবে আদেশের বিষয়টি তিনি শুনেছেন।

“আমি সকাল বেলা শুনলাম প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, তিনি বিজ্ঞ বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। আপনারা লেখেন বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কেড়ে নেয়ার কথাটার মানে হচ্ছে জোর করে কেড়ে নেওয়া। এটা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না। এই রকম যদি ঘটনা ঘটে মাননীয় প্রধান বিচারপতির এই ক্ষমতা আছে তাকে বিচারিক ক্ষমতা থেকে কিছুদিন সরিয়ে রাখা।”

মন্ত্রী বলেন, “বিচারিক কাজ থেকে তাকে যে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হচ্ছে, সেটা প্রধান বিচারপতি নির্দেশ দিলে আমরা একটা জিও করব। প্রধান বিচারপতিকে আমি কিছু বলিনি। উনি স্ব-প্রণোদিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

তিনি জানান, প্রধান বিচারপতির চিঠি পেলে এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এরপর আইন অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট ওই বিচারককে কারণ দর্শানোর নোটিস দেবে।

তবে বিচারক কামরুন্নাহারের দেওয়া রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি আইনমন্ত্রী।

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে বৃহস্পতিবার আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার।

তার সঙ্গে ধর্ষণ প্রমাণে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতার যুক্তি দিয়ে ওই সময়ের পর মামলা না নিতে পর্যবেক্ষণ দেন তিনি।

বিচারক বলেন, অভিযোগকারী তরুণী ‘স্বেচ্ছায়’ রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে আসামির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, সেখানে ‘ধর্ষণ ঘটেনি’। তদন্ত কর্মকর্তা ‘প্রভাবিত হয়ে’ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। 

বিচারকের ওই পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনাই শুধু নয়, সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মনে মত দেন অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। এরপর রোববার সকালে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা আসে। 

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “কথা হচ্ছে- এটা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন। বিজ্ঞ বিচারকগণ প্রতিদিনই কিন্তু রায় দেন। রায়ে কেউ সন্তুষ্ট হয়, কেউ অসন্তুষ্ট হয়। যারা অসন্তুষ্ট হন, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী সংবিধান অনুযায়ী তারা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন।

“সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে আপিল বিভাগ। সেই আপিল বিভাগের সাংবিধানিক কিছু বাড়তি ক্ষমতাও আছে। সেগুলো তারা প্রয়োগ করে। রায় দিলেই যে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা নয়। তারা মেরিটের উপরে, আইনের উপরে, রায় দেওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।”

তাহলে এখানে কেন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা আসছে, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে আনিসুল হক বলেন, “এখানে একজন বিজ্ঞ বিচারক ওপেন কোর্টে রায় দেওয়ার সময় তার পর্যবেক্ষণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছেন, ৭২ ঘণ্টা পর কেউ যদি কোনো ধর্ষণ মামলা করতে আসে, তাহলে সেই মামলাটা গ্রহণ না করতে। এটাই হচ্ছে আপত্তির জায়গা।

“ব্যাপারটা হচ্ছে, কোন ফৌজদারি অপরাধের মামলা করার ব্যাপারে তামাদি বারিত হয় না (নট বার বাই লিমিটেশন)। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর কিন্তু মামলা হয়নি। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর এই মামলার প্রথম এফআইআর হয়।”

সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ থেকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রী বলেন, “স্পষ্ট বলা আছে, একমাত্র আইন দিয়ে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে বা পক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচারকের বক্তব্যটি সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি। এই দুটোই তিনি ভায়োলেট (লঙ্ঘন) করেছেন।

“এই ভায়োলেশনের তাৎপর্যটা কী? অনেক রায় আছে বেআইনি হয়, আপিল বিভাগে গিয়ে বাতিল হয়। এখানে তিনি যে কথাটা বলেছেন, সেটার একটা ইপ্লিকেশন আছে, একটা কনিসিকিউয়েন্স আছে। এ কারণেই আজকে বিচার বিভাগের যিনি গার্ডিয়ান, যিনি প্রধান, তাকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। ঠিক সেই কারণেই আমি আইনমন্ত্রী হিসেবে নির্বাহী বিভাগ থেকে গতকাল বলেছিলাম, আমি প্রধান বিচারপতির কাছেই বিচার চাইতে পারি। কারণ বিচার বিভাগ স্বাধীন।”

আনিসুল হক বলেন, “আমার মনে হয় যে, এটা বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য বিব্রতকর। এটা একটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভুল নির্দেশনা দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল, সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেটাও সম্পূর্ণ আইনানুগভাবে কিন্তু এগিয়ে যাবে।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় কোনো ‘ভুল বার্তা’ যাবে বলে তিনি মনে করেন না। বরং সরকার বা নির্বাহী বিভাগ যদি এক্ষেত্রে পদক্ষেপ না নেয়, তাহলেই ‘ভুল বার্তা’ যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।

ওই বিচারকের সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “আমি বিজ্ঞ বিচারকদের সাথে কথা বলি না। উনার ডিফেন্স উনি নেবেন। সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলবে।”

পুরনো খবর