ঢাকার গুলিস্তান থেকে সদরঘাটের বাহাদুরশাহ পার্ক পর্যন্ত দূরত্ব ২ দশমিক ১ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত সর্বশেষ হার অনুযায়ী এ পথে ভাড়া হয় ৩ টাকা ৫৭ পয়সা; কিন্তু নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা।
Published : 07 Nov 2021, 08:51 AM
শাহবাগ থেকে ফার্মগেট আনন্দ সিনেমা হল পর্যন্ত ২ দশমিক ২ কিলোমিটারের সরকার নির্ধারিত হারে ভাড়া হওয়ার কথা ৩ টাকা ৭৪ পয়সা; নেওয়া হচ্ছে ১০ টাকা।
এখন রাজধানীর কোনো রুটেই ১০ টাকার কম ভাড়া আদায় করা হয় না; দূরত্ব যাই হোক। যদিও সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন দূরত্বের ভাড়া ৭ টাকা হওয়ার কথা।
এ হিসাবে সর্বনিম্ন ভাড়াও কিলোমিটার হিসাবে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ। তবুও সবগুলো রুটের বাস আদায় করছে অতিরিক্ত তিন টাকা। যাত্রীদের হাজারো প্রতিবাদ ও বিবাদেও কোনো কাজ হয়নি; ১০ টাকাই যেন নিয়ম হয়ে গেছে।
ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর কারণে নতুন বাসা ভাড়া নির্ধারণে রোববার পরিবহন মালিকদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকের আগে ফিরে আসছে অতীতের অভিজ্ঞতা।
ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সারা দেশের মানুষকে গত তিন দিন ধরে কার্যত জিম্মি করে রেখেছেন পরিবহন মালিকরা। এখন প্রশ্ন উঠছে, রোববার যে ভাড়াতেই সমঝোতা হোক, রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা মানবেন?
“আমরা মনে করি তেলের দাম বাড়ানোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভাড়া বাড়াতে হবে। এ ভাড়া যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত যেন কেউ আদায় করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে কঠোর হতে হবে।”
পরিবহন মালিকদের প্রভাবশালী নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহও নগরীর ‘কিছু রুটে’ বাড়তি ভাড়া আদায়ের কথা স্বীকার করছেন।
এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রায়ই ব্যবস্থা নেওয়া হয় দাবি করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দূরপাল্লার অনেক গাড়ি আছে কম ভাড়াও নেয়। ঢাকা একটু ব্যতিক্রম, এখানে কোথাও কোথাও অনিয়ম হয় সেটা অস্বীকার করার কারণ নেই।“
নতুন করে ভাড়া নির্ধারণের পর কী হবে- সেই প্রশ্নে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এই মহাসচিব বলেন, “আমিও চাই এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে। প্রশাসনের লোক, বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালত সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এমন হবে না।”
পরিবহন মালিকদের দাবিতে ভাড়া বাড়লেও তা যেন জনগণের জন্য ‘সহনীয়’ হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখার আশ্বাস দিয়েছেন সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রতিবেশী দেশে জ্বালানি পাচার রোধে সরকার অনিচ্ছা স্বত্বেও ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য পুনঃনির্ধারণ করেছে। তবে এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকার সবসময়ই জনস্বার্থের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে।”
সরকার বৃহস্পতিবার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর শুক্রবার সকাল থেকে বাস ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলো।
তারা ভাড়া বাড়ানোর দাবি তোলায় রোববার বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ব্যয় বিশ্নেষণ কমিটি।
ওবায়দুল কাদের ধর্মঘট তুলে নেওয়ার আহ্বান জানালেও বৈঠকের আগে তা তুলতে নারাজ পরিবহন মালিকরা। ফলে সড়কে মানুষের ভোগান্তি থামেনি।
তেলের পাশাপাশি গ্যাসচালিত বাসও বন্ধ রাখা হয়েছে এই ধর্মঘটে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ভুক্তভোগী নাগরিকরা।
পরিবহন মালিকরা বলছেন, সিএনজিতে চলে এমন বাসের সংখ্যা ‘খুবই কম’। তাছাড়া গত ছয় বছরে গ্যাসের দাম ১৩ টাকা বাড়লেও ভাড়া বাড়েনি।
এখন ভাড়া কত? বেড়ে কত হবে?
সরকার সবশেষ ২০১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নগর পরিবহনে বাসের ভাড়া প্রতি কিলেমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং মিনিবাসের জন্য ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়। বাসের ৭ টাকা এবং মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ নির্ধারণ করা হয়। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয় ওই বছরের ১ অক্টোবর থেকে।
তার আগে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১ টাকা ৩৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়।
ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালের ৩ মে দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটের ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ৩ পয়সা কমানো হয়। ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১ টাকা ৪২ পয়সা।
ভাড়ার হার পুনর্নির্ধারণের দাবি জানিয়ে ২০১৯ সালে বিআরটিএতে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
সেখানে বলা হয়, ওই বছর গ্যাসের দাম বাড়ায় যানবাহনের পরিচালনা ব্যয় সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়ে যায়। ঢাকা ও আশপাশের জেলায় চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ৪০ শতাংশ সিএনজিতে চলে। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া সবশেষ ২০১৫ সালে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল। এছাড়া ডিজেলচালিত বাসের ভাড়াও বাড়ানো হয়নি।
এ কারণে পরিবহন মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়েছেন দাবি করে সারাদেশে সিএনজি ও ডিজেলচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
সে সময় নগর পরিবহনের বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে এক টাকা ৭০ পয়সা বাড়িয়ে দুই টাকা ২১ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। আর দূরপাল্লা বাস ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৭ পয়সা করার কথা বলা হয়েছিল। তবে বিষয়টি পরে আর এগোয়নি।
এখন ডিজেলের দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে মালিকরা আরও বেশি ভাড়া নির্ধারণের দাবিতে সারা দেশ অচল করে রেখেছেন। তবে কত ভাড়া তারা চান, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব তারা বৈঠকের আগে বলছেন না।
এবার বাসের ভাড়া কত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে জানতে চাইলে পরিবহন মালিকদের আরেক বড় সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ সাধারণ সম্পাদক রাকেশ ঘোষ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৯ সালে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বাড়িয়ে ২ টাকা ৭ পয়সা করার আবেদন করেছিলেন তারা।
“এরপর যন্ত্রপাতির দাম, টোলসহ সবকিছুই বেড়েছে। আমাদের প্রস্তাব একটা দেওয়া আছে। নতুন করে কত টাকা ভাড়া বাড়ানো যায় তা বিআরটিএ নির্ধারণ করবে। কস্টিং ঠিক করার একটা কমিটি আছে, তারা মালিকদের সঙ্গে আলাপ করে ঠিক করবে।”
মানা হয় না সরকারি ভাড়া
প্রতিবার সরকার সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বিরুদ্ধে নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়ের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বেশি আদায়ের অভিযোগ সবসময় করে আসছেন যাত্রীরা।
এ অবস্থায় নতুন করে ভাড়া নির্ধারণ করলে তা পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা মেনে চলবে কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন যাত্রী ও অধিকারকর্মীরা।
সরকার নির্ধারিত ভাড়ার সঙ্গে রাজধানীর কয়েকটি রুটের দূরত্ব হিসাব করে দেখা গেছে, এসব রুটে বর্তমানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।
সাইনবোর্ড থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব সাড়ে আট কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার হিসাবে ভাড়া আসে ১৪ টাকা ৪৫ পয়সা। এ রুটে চলাচলকারী প্রায় প্রতিটি বাসে ভাড়া নেওয়া হয় ২০ টাকা করে।
মহাখালী থেকে বিমানবন্দরে পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া আসার কথা ১৭ টাকা; নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
যেমন- উত্তর বাড্ডা থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত দূরত্ব দুই কিলোমিটার। এ পথে ভাড়া আসার কথা ৩ টাকা ৪০ পয়সা। গত তিন-চার বছর ধরেই ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উত্তর বাড্ডার বাসিন্দা মিল্লাত হোসেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ভাড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা সবসময়ই ছিল। শত চিৎকার-প্রতিবাদেও কোনো সমাধান হয়নি। গা সওয়া হয়ে গেছে সবার।
“এটা সব সময়ই হচ্ছে। যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার আসলে কেউ থাকে না। যারা কথা বলেন তারাও বাসে চড়েন না কখনও। ফলে যাত্রী অধিকারের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায় সব সময়। নতুন ভাড়া নির্ধারণের পর তা যেন মালিক-শ্রমিকরা মেনে চলেন, এটা নিশ্চিত করতেই হবে।”
দূরত্বের হিসাবে কারসাজি করে নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান রুটের বাসগুলো আগে থেকেই বেশি ভাড়া নিচ্ছে বলে অভিযোগ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা সজল সেনগুপ্তের।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাটের দূরত্ব ১৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৭০ পয়সা হিসেবে ভাড়া আসে ২৯ টাকা ৭৫ পয়সা। এ রুটের বিভিন্ন পরিবহনের বাসে ৩৬ টাকা করে আদায় করা হয়।
“ডিজেলের দাম বাড়ার পর বৃহস্পতিবার ওই ভাড়া এক লাফে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে ফেলেছে।”
বৈঠকের পর তা যে কত হবে না দুশ্চিন্তা প্রতিদিন এ রুটে যাতায়াতকারী এ চাকরিজিবীদের।
ঢাকার গুলিস্তান থেকে নরসিংদী বাসস্ট্যান্ডের ব্যবধান ৪৮ কিলোমিটার। ১ টাকা ৭০ পয়সা হিসাবে ৮১ টাকা ৬০ পয়সা ভাড়া হলেও নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকা করে।
এ রুটের নিয়মিত যাত্রী হুমায়ুন কবির বলেন, ভাড়া আগে থেকেই বেশি নেওয়া হচ্ছে। এখন সুযোগ পেয়ে আরও বাড়াবে।
“তারা দাবি করে কাউন্টার সার্ভিস। বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলে- সিটিং সার্ভিস শুধু মুখে আর কাগজেই। মাঝেমধ্যে এমন ভিড় হয় যে কোথাও নামার সময় অনেক ধাক্কাধাক্কি হয়।”
পুরনো খবর: