পরিবহন ধর্মঘট: রোববার পর্যন্ত ভুগতে হবে?

ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষাপটে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে সারা দেশের মানুষকে যে ভোগান্তিতে পড়তে হল, তা এড়ানোর কোনো উপায় কি ছিল না?

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Nov 2021, 06:18 PM
Updated : 5 Nov 2021, 06:19 PM

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলছেন, আলোচনার উদ্যোগ তারা নিয়েছেন, কিন্তু শুক্র-শনি দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় সেই বৈঠক হবে রোববার।

অন্যদিকে পরিবহন মালিকদের প্রভাবশালী নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলছেন, বৈঠক যেহেতু রোববার, তার আগে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ‘কোনো সম্ভাবনা নেই’।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী শুক্রবার ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন; তেলের দামের অজুহাতে পণ্যের দাম যে না বাড়ে, সে বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।

কিন্তু সমঝোতার চেষ্টা বা কঠোর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় রোববার পর্যন্ত মানুষের ভোগান্তিই যেন অবধারিত হয়ে উঠছে।

শুক্রবার সকালে কাজে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে বিপাকে পড়া মিরপুরের একটি শপিং মলের বিক্রয়কর্মী তরিকুল ইসলাম বললেন, “সমস্যা হলে তারা আলোচনা করে সমাধান করুক, আমাদের জিম্মি করছে কেন?”

ঢাকার কাঁচাবাজারে ধর্মঘটের প্রভাব এখনও সেভাবে না পড়লেও শুক্রবার রাতে ট্রাক না এলে শনিবার কী হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন বিক্রেতারা। আর চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ধর্মঘটের প্রথম দিন থেকেই।

সরকার বুধবার মধ্যরাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর বৃহস্পতিবার ধর্মঘটের ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কয়েকটি সংগঠন। সে অনুযায়ী, শুক্রবার সকাল ৬টা থেকেই সারাদেশে বাস ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা হয়।

ছেলের চিকিৎসার জন্য আট দিন হাসপাতালে কাটিয়ে শুক্রবার সকালে বাড়ির পথ ধরতে গিয়েই পরিবহন ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েন কুষ্টিয়ার দিলারা খাতুন ও পরিবারের সদস্যরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শুক্রবার ছুটির দিন বলে মানুষের বের হওয়ার প্রয়োজন ছিল কম। কিন্তু যাদের জরুরি প্রয়োজনে বের হতে হয়েছে, তাদের ভোগান্তির শেষ ছিল না। 

দূরপাল্লার যাত্রীদের বাস টার্মিনালে গিয়েও ফিরে যেতে হয়েছে। অনেকে ভিড় করেছেন ট্রেন স্টেশন বা লঞ্চ ঘাটে। লঞ্চেও ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

নগর-মহানগরে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষকে পথে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে বিপাকে। এ ধর্মঘটের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থীকে।

এক দিনে দেড় ডজন নিয়োগ পরীক্ষা থাকায় যানবাহন সঙ্কটের মধ্যে নাকাল হতে হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদেরও।

শনিবারও সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষা আছে; সকালে আছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা। বিকালে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এবং পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা রয়েছে।

পাশাপাশি অনেক বেসরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খোলা থাকছে। শুধু ভোগান্তি লাঘবের কোনো আশা কেউ দেখাচ্ছেন না। 

ডিজেলের দাম বাড়ার নানামুখী প্রভাব শেষ পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকদের ওপরই পড়বে। কিন্তু বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট ডেকে নাগরিকদের কেন এভাবে ভোগান্তিতে ফেলা হবে, আর আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে কেন দেরি হবে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তারা।  

বাস না পেয়ে ঢাকার রামপুরা থেকে রিকশা করে সদরঘাটে যাচ্ছিলেন শরীয়তপুরের শেখ আফজাল হোসেন। তিনি বললেন, “লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে, মালিকরা বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে। সরকারের হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। এখন আমার মনে হচ্ছে বাস ভাড়া অনেক বেশি বাড়িয়ে দেবে। এটা সাধারণ মানুষের ওপর বাড়তি চাপ হবে।"

ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটের কারণে শুক্রবার ঢাকার দারুসালাম সড়ক ছিল বাসশূন্য। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গাজীপুরের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহানকে সকালে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ কেন্দ্রে আসতে হয় অটোরিকশা ভাড়া করে।

চোখেমুখে ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, “অনেক টাকা খরচ করে আসতে হল। সবাই তো ঢাকায় থাকে না। তাদের যে কি ভোগান্তি হচ্ছে, বলে বোঝানো যাবে না। আমরা পরিচিত কয়েকজন পরীক্ষা দিতেই আসেনি।”

মিরপুর ১২ নম্বরে পল্লবী মহিলা ডিগ্রি কলেজে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পরিসংখ্যান সহকারী পদে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন দেলোয়ার হোসেনের মেয়ে।

পরীক্ষা কেন্দ্রের সামনে অপেক্ষায় থাকা দেলোয়ার বললেন, “মতিঝিল থেকে দুইজন ৮০ টাকা বাস ভাড়ায় চলে আসতে পারতাম, কিন্তু ৪০০ টাকা ভাড়ায় সিএনজিতে আসতে হল। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্তদের অনেক হিসাবনিকাশ করে মাস চালাতে হয়।

“মেয়ের এক পরীক্ষার পিছনেই যদি এক হাজার টাকা শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাকি দিন চলা কঠিন হয়ে যাবে। কয়দিন এ অবস্থা থাকে কে জানে! সরকারের উচিত দ্রুত এর সামাধান করা।”

তারা যা বললেন

ভাড়া বাড়ানোর জন্য বৃহস্পতিবারই সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিল মালিক-শ্রমিকদের সংগঠনগুলো। কিন্তু সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিআরটিএ বৈঠক ডেকেছে রোববার বেলা ১১টায়।

তবে ধর্মঘট তুলে নেওয়ার বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে মালিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের শুক্রবার সকালে ঢাকায় নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে পরিবহন মালিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট প্রত্যাহারে আহ্বান জানিয়েছিলেন।

এ বিষয়ে এনায়েত উল্লাহর ভাষ্য, মন্ত্রীর আহ্বানের কথা তারা গণমাধ্যমের মারফতে জেনেছেন। ‘সরাসরি’ কেউ কিছু বলেনি।

ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে শুক্রবার ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি দূরপাল্লার বাস। ছবি: কাজী সালাহউদ্দিন রাজু

দেশের অন্যতম প্রভাবশালী পরিবহন সংগঠনের এই নেতা বলেন, রোববার সকাল ১১টায় বিআরটিএর কার্যালয়ে বৈঠক করতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান পরিবহন মালিকদের টেলিফোনে ‘দাওয়াত’ দিয়েছেন। তারা আগে সমাধানের কোনো আশা তিনি দেখছেন না।

“এটা আশ্বাসের বিষয় না, সমাধানের বিষয়। সমাধানের আগে আমরা ধর্মঘট তুলে নিতে পারব না। সারাদেশের জেলায় জেলায় ধর্মঘট চলছে। কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া আমরা যদি ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বলি, তাহলে বিষয়টি কেন্দ্রীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”

সড়ক পরিবহন খাতের আরেক বৃহৎ সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসম্পাদক এবং শ্যামলী এন আর পরিবহনের মালিক রাকেশ ঘোষ শুক্রবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃহস্পতিবার কর্মসূচি ঘোষণার পর শুক্রবারই মালিকদের সঙ্গে বিআরটিএর বৈঠক হলে মানুষের ভোগান্তি ‘অনেক কম’ হত। পরিবহন মালিকরাও ‘স্বস্তি’ পেতেন।

“রোববার তো যে কোনো একটা ফয়সালা হবেই। সরকারি ছুটির দিন বিবেচনা না করে শনিবারই আমাদের সঙ্গে বসে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটা সমাধান করলে ভালো হয়।“

পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘটে শুক্রবার সারাদেশে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে গন্তব্যের পথে রওনা হন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পরিবহনের যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা প্রভাবশালী আবার পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীও প্রভাবশালী।

“এখন তারা যদি সমঝোতায় আসতে না পারেন, যদি শুধু জনগণকে জিম্মি করেই স্বার্থ হাসিল করতে চান তাহলে তা দেশের পরিবহন খাতের শুভ ফল বয়ে আনতে পারবে না। আমি আমি মনে করি ধর্মঘট প্রত্যাহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করবে।”

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানও দ্রুত আলোচনার ওপর তাগিদ দিচ্ছেন। 

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সরকারের উচিত হবে জনদুর্ভোগ যেন আর না বাড়ে সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব আলোচনা করুক। তাদের বুঝিয়ে হোক, যেভাবেই হোক ধর্মঘট প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করুক।”

রোববারের আগে মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করা যেত কি না জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শুক্রবার ও শনিবার সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় তারা বৈঠক করতে পারেননি।

“বন্ধের মধ্যে হঠাৎ পড়ে গেছে। অফিস ডে হলে আমরা তাৎক্ষনিকই বৈঠক ডাকতাম। সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাভেইলেবেলিটির ওপর নির্ভর করেই বৈঠকের তারিখ দেওয়া হয়েছে, সবার সম্মতিতে।”

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী যে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন, সে কথা তুলে ধরে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, “উনারা ভাড়া বৃদ্ধির জন্য আবেদন করেছেন, বিষয়টি আমরা কনসিডার তো করছি। এজন্যই মিটিং ডাকা। কমিটি নির্ধারণ করবে ভাড়া কত বাড়বে। এটা একক ব্যক্তির বিষয় না।”

পরিবহন ধর্মঘটে বাস চলেনি শুক্রবার। ঢাকার তেজগাঁও রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন থামতেই হুড়োহুড়ি করে তাতে ওঠার চেষ্টায় নিরুপায় যাত্রীরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বাজারের খবর কী?

শুক্রবার সকালে আগের দিনের মতই ১২ টাকা কেজি দরে কাঁচা পেঁপে পাওয়া গেছে মিরপুর-১ নম্বর এলাকায় শাহ আলীর মাজার সংলগ্ন সবজির আড়তে। একইভাবে ৪০ টাকা কেজিতে বরবটি, ৩০ টাকা কেজিতে শসা বিক্রি হচ্ছিল।

মাজার রোডের আড়ৎদার পার্থ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতরাতে ধর্মঘটের কারণে সবজির ট্রাক আসতে বেশ খানিটা দেরি করেছে। রাত ৩টার দিকে আসার কথা থাকলেও সেই ট্রাক এসেছে সকাল ৮টায়। তবে ভাড়া বাবদ এদিন বাড়তি টাকা দাবি করা হয়নি। তবে কাল কী হবে সে বিষয়ে নিশ্চিয়তা দিতে পারেনি ট্রাক চালকরা।“

পণ্য পরিবহনে ধর্মঘট চললেও কাঁচামাল সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় নতুন করে দাম বাড়াতে হয়নি বলে জানিয়েছেন ঢাকার আড়ৎদাররা। তবে শুক্রবার রাতে পণ্যের সরবরাহ কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে তাদের।

দেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা থেকে ৯ হাজার টাকায় ছোট ট্রাক, ১৬ হাজার টাকায় মাঝারি আকারের ট্রাকগুলো ঢাকায় আসে।

তুষার ইমরান নামের একজন ট্রাক মালিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রথম দিনে পূর্ব নির্ধারিত ভাড়ায় ঢাকায় আসতে হয়েছে। এতে আমাদের আর লাভ থাকছে না। আগামীকাল থেকে নতুন নির্ধারিত ভাড়ায় আসতে হবে। কারণ জ্বালানির দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে দেড় দুই হাজার টাকা বেশি খরচ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।”