জলবায়ু উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব বিশ্বকে ভাগ করে নিতে হবে: প্রধানমন্ত্রী

জলবায়ু সঙ্কটে বাস্তু হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে যাদের অভিবাসী হতে হচ্ছে, তাদের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2021, 05:39 AM
Updated : 3 Nov 2021, 02:44 PM

তিনি বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনায় বাস্তুচ্যুত হওয়া জলবায়ু অভিবাসীদের  দায়িত্ব বিশ্বকে অবশ্যই ভাগ করে নিতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই সঠিকভাবে সমাধান করতে হবে।“

রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা বাসস জানায়, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন উপলক্ষে স্কটল্যান্ড সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার স্কটিশ পার্লামেন্টে আয়োজিত ‘কল ফর ক্লাইমেট প্রসপারিটি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ৬০ লাখ মানুষ জলবায়ু সঙ্কটে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অতিরিক্ত আরো ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভার বইতে হচ্ছে। এ সমস্যার মোকাবেল করা আরও কঠিন করে তুলেছে কোভিড-১৯ মহামারী।

স্কটিশ পার্লামেন্টে কমিটি কক্ষে এ আয়োজনে ‘আ বাংলাদেশ ভিশন ফর গ্লোবাল ক্লাইমেট প্রসপারিটি’ শিরোনামে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন শেখ হাসিনা।

স্কটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছালে স্পিকার অ্যালিসন জনস্টোন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।

বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এবং সিভিএফ দূত সায়মা ওয়াজেদ হোসেনও উপস্থিত ছিলেন এ সময়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভালনারেবল২০ (ভি২০) সভাপতি শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেন, কার্যকর ও পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়নই হতে পারে সমৃদ্ধি অর্জনের চাবিকাঠি।

এমসিপিপি (মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান) সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু সুপারিশ তিনি তুলে ধরেন।

শেখ হাসিনা বলেন, সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলেকে অবশ্যই নির্গমন কমিয়ে আনার ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় পরিকল্পনা (এনডিসি) ঘোষণা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

“প্রশমনের ব্যাপক উদ্যোগ ছাড়া, শুধুমাত্র অভিযোজনের চেষ্টা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বিলম্বিত করা, ঠেকানো বা পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার যে অঙ্গীকার উন্নত দেশগুলো দিয়েছে, তাদের তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে। ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে এক্ষেত্রে বাড়তি গুরুত্ব দিতে হবে।

আর এই অর্থায়ন হতে হবে বিদ্যমান উন্নয়ন সহায়তার অতিরিক্ত। বিভিন্ন জলবায়ু তহবিলের মধ্যে সমন্বয় রাখার ওপরও জোর দেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, জলবায়ু তহবিলের অর্থ বিতরণে অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সমান বণ্টন হওয়া উচিত।

আরেক প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হস্তান্তরের কথা বলেন, যাতে মুজিব জলবায়ু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। 

শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। অভূতপূর্ব এই চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে বিশ্ব নেতারা গ্লাসগোতে সমবেত হয়েছেন তাদের প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের কথা জানাতে।

সম্প্রতি প্রকাশিত আইপিসিসির (জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল) প্রতিবেদনকে বিশ্বের জন্য আরেকটি সতর্কবার্তা হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা মানবজাতির সবচেয়ে গুরুতর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশের মত ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় হুমকি, যদিও বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে এসব দেশের অবদান ০.৪৭ শতাংশেরও কম।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘গুরুতর হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট দেশীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে নষ্ট হচ্ছে এবং আগামী দশকে তা নয় শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলেও তথ্য তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।  

এই বিপদ মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) প্রতিষ্ঠা করেছে। এই তহবিলের আওতায় বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৪৮ কোটি ডলার বিনিয়োগসহ ৮০০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব প্রকল্পে অভিযোজন, প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

১০০ বছরের ডেল্টা প্ল্যানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) প্রণয়ন করা হচ্ছে, যা আমাদের অভিযোজনের লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।”

গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বলে বক্তৃতায় জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দশটি প্রকল্পও সরকার বাতিল করেছে।

“২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ শক্তি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদন করাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা আমাদের মাস ট্রানজিট সিস্টেমের জন্য বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভও সংগ্রহ করছি। এতে আমাদের কার্বন নির্গমন আরও হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু করবে। এসব গাড়ির জন্য সারা দেশে চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা আশা করি, পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের জন্য আমরা বৈশ্বিক তহবিল থেকে অর্থায়ন পাব এবং আমাদের তরুণদের শিক্ষার মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারব। দ্রুত একটি উন্নত দেশের মর্যাদা লাভের লক্ষ্যে পৌঁছাতে এটা আমাদেরকে সাহায্য করবে।”