ফেরিতে পানি উঠছে, কেউ কেন দেখল না?

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে আসতে একটি রো রো ফেরির ৪০ মিনিট লাগে। বুধবার সকালে ডুবে যাওয়া ফেরি শাহ আমানতে থাকা ট্রাকচালকরা বলছেন মাঝনদীতেই ফেরিতে পানি উঠতে দেখেন তারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2021, 08:01 PM
Updated : 27 Oct 2021, 08:01 PM

প্রশ্ন উঠেছে, সেক্ষত্রে ফেরি পরিচালনাকারীরা কেউ তা দেখল না কেন কিংবা দেখলেও সতর্কবার্তা কেন দিল না? ফেরিতে পানি উঠেছিল কেন, সেটাও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার ওসি ফিরোজ কবির বলেছেন, ফেরির নিচে ‘ব্যালাস্ট ট্যাংক (বায়ু পূর্ণ পানি নিরোধক কক্ষ)’ থাকে, সেখানে ফুটো হয়ে পানি ঢোকায় নৌযানটি ভারসাম্য হারিয়ে উল্টো যায় বলে তারা ধারণা করছেন।

এক প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক মো. আশিকুজ্জামান বলেন, “ভেতরে পানি ঢুকলে তো ফেরি ঘাটে আসতে পারত না, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেত। আবার এভাবে কাত হয়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছে ভেতরে পানি ঢুকছে হয়ত। কিছুই বুঝতে পারছি না।”

বিআইডব্লিউটিসির অন্যান্য ফেরির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তলা ফাটার বিন্দুমাত্র উপসর্গ দেখামাত্রই নৌযান চালকেরা কাছের কোনো চরে সেটিকে ভিড়িয়ে দেন। ঘাটেও জরুরি বার্তা দেওয়া হয়।

তাহলে ফেরি শাহ আমানতের চালক প্রায় আধ ঘণ্টা সময় চালিয়ে নিয়ে ফেরিটিকে সাধারণভাবে পন্টুনে ভেড়াতে গেলেন, কেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ফেরি থেকে জরুরি অবস্থার কোনো বার্তা দেওয়া হয়েছিল কি না- বিআইডব্লিউটিএর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আলম এই প্রশ্নে বলেন, তারা যখন ঘটনাটি জেনেছেন ছুটে এসে ফেরিটিকে কাত অবস্থায় দেখতে পেয়েছেন। এ বিষয়ে ফেরি দেখভালকারী সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি ‘আরও ভালো’ বলতে পারবে।

একই প্রশ্নে বিআইডব্লিউটিসি'র চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, ফেরি থেকে জরুরি বার্তা দেওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু শোনেননি।

“তবে তদন্ত কমিটি কাজ করছে, সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তারা আরও ভাল বলতে পারবে,” বলেন তিনি।

রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে যানবাহন নিয়ে বুধবার সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর পাটুরিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল শাহ আমানত। পদ্মা পার হয়ে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ার ৫ নম্বর ফেরিঘাটে পৌঁছানোর পরপরই সেটি কাত হয়ে নদীতে উল্টে যায়।

৮০০ টন ওজনের শাহ আমানত ফেরি ২৫টি যানবাহন বহন করতে পারে। দুর্ঘটনার সময় ফেরিতে ছিল ১৭টি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার ও আটটি মোটরসাইকেল।

ফেরির চালক শরিফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ঘাটের কাছে এসে ফেরিতে পানি ঢুকতে শুরু করে। তিনি উপরে পরিচালন কক্ষে ছিলেন। তাই কী করে পানি ঢুকল, তিনি সেটি বলতে পারেন না। 

পানি ঢোকার বিষয়ে ঘাটেও কোনো জরুরি বার্তা আসেনি, ফলে সেখানেও কোনো প্রস্তুতি ছিল না।

ফেরিতে থাকা ট্রাকের চালকরা বলছেন, তারা মাঝ নদী থেকেই ফেরির পাটাতনে পানি দেখতে পেয়েছিলেন। 

আশানুর, মোহাম্মদ সেলিমসহ অন্তত তিনজন ট্রাকচালক বলছেন মাঝ নদী থেকেই তারা ফেরিতে পানি দেখতে পেয়েছেন। 

আফজাল সার্ভিসেস নামে একটি সংস্থার কভার্ড ভ্যানচালক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, ফেরিটি দৌলতদিয়া ছাড়ার কিছুক্ষণ পর পাটাতনে পানি দেখতে পান তিনি। তখন তিনি ভেবেছিলেন হয়ত তার ট্রাকের রেডিয়েটার ফেটে পানি বেরিয়েছে।

পরে হেলপারকে তাকে জানায়, হেলপার এসে জানায় রেডিয়েটর ফাটেনি, ফেরির বাম পাশ থেকে ডান পাশ পানি গড়িয়ে যাচ্ছে।

তখন ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি সেলিম। ফেরি ঘাটে ভেরার আগে ট্রাকের লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখেন পেছনে অনেক পানি। ফেরির চালক সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফেরিটি পাটুরিয়া ঘাটে ভেড়ায়। দ্রুত তিনটি ট্রাক নেমে যায়। চতুর্থ ট্রাকটি ছিল সেলিমের। কিন্তু তিনি ডুবতে থাকা ফেরির সঙ্গে সেলিমের ট্রাকের একটা অংশও ডুবে যায়।

ট্রাকে করে লোহার অ্যাঙ্গেল বহন করছিলেন চালক ইয়াকুব ও হেলপার মামুন। তাদের গাড়িটি তলিয়ে রয়েছে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ইয়াকুব আর মামুন চিৎকার করে বলছিলেন- “এইডা কেমন ফেরির ড্রাইভার। তলা ফাটলে সবার আগে চরে উঠাইব। তাইলে আর নড়াচড়া করতে পারত না। ঘাটে ভিড়াইতে যে সময় নষ্ট হয়েছে সেটা না করলে হয়তো এত বড় ঘটনা ঘটত না।”

পানি উঠছে দেখেও ফেরির কর্মীরা কেন আগাম কোনো ব্যবস্থা নিল না, কোনো বার্তা দিল না, সেটাই পরিবহনকর্মীদের প্রশ্ন।

ফেরি ছাড়ার আগে তার ফিটনেস যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকে জানিয়ে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান বলেন, “প্রতিটা ফেরি যানবাহন নিয়ে ছাড়ার আগে একবার করে চেক করার নিয়ম রয়েছে। এই ফাইলটি ছাড়ার আগে নিয়ম মেনে চেক করা হয়েছে কি না, তা যাচাই করবে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত দল।”

এই নৌ দুর্ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিসি, যার আহ্বায়ক করা হয়েছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুলতান আব্দুল হামিদকে।

এই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।