অনেক পরিচয়ে ‘প্রতারণা’, গ্রেপ্তার হোমল্যান্ড সিকিউরিটির শাহীরুল

নিজেকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসের প্রধান, কখনও মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান, কখনও সরকারি কর্মকর্তার পরিচয় দিতেন তিনি। এসব পরিচয়ে চাকরি দেওয়ার নামে তিনি দীর্ঘদিন থেকে প্রতারণা করে আসছিলেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Oct 2021, 02:07 PM
Updated : 23 Oct 2021, 02:18 PM

শেষ পর্যন্ত র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে শাহীরুল ইসলাম সিকদারের (৪৮) প্রতারণার মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীদের বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো সামনে এসেছে।

শনিবার সকালে বনশ্রী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার এ ব্যক্তিকে র‌্যাব কর্মকর্তারা ‘শীর্ষ পর্যায়ের’ একজন প্রতারক বলে উল্লেখ করেছেন।

বিকালে কারওয়ান বাজার মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, চাকুরি দেওয়ার নামে শাহীরুলের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা পুরাতন হলেও মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী এ ব্যক্তির প্রতারণার ইতিহাস ‘ধৃষ্টতাপূর্ণ’ ও ‘ভিন্নধর্মী’।

“শাহীরুল একজন শীর্ষ পর্যায়ের প্রতারক। সে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিস লিমিটেড নামের কোম্পানি খুলে এবং নিজেকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে চাকরি প্রদানের নামে প্রতারণা করে আসছিল।“

তাকে গ্রেপ্তারের প্রেক্ষাপটের বিষয়ে এই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী শাহিরুলের বিরুদ্ধে র‌্যাব-৪ এর নিকট চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার বিষয়ে অভিযোগ ছিল। চাঁদাবাজি করার অপরাধে তার নামে রামপুরা থানায় চাঁদাবাজি ও প্রতারণার মামলাও রয়েছে।

তিনি জানান, শাহিরুল নিজেকে একটি কথিত মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসের নামের ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দেয়।

“চাকুরি দেওয়ার নামে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে এ ব্যক্তি।“

বনশ্রী থেকে গ্রেপ্তারের সময় তার বাসায় তিনটি বিদেশি পিস্তল, একটি শর্টগান, একটি এয়ারগান,  ২৩৭ রাউন্ড গুলি, চারটি চাকু ও তিনটি ডামি পিস্তল জব্দ করে র‌্যাব।

এছাড়া বুলেট প্রুপ জ্যাকেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যান্ড গার্ড সার্ভিসের চাকরির আবেদন ফর্ম, চুক্তিপত্র, মানি রিসিভ বই, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও এটিএম কার্ড, ব্যানার, প্যাড, স্ট্যাম্প, ল্যাপটপ, ডেক্সটপ, গোপন ক্যামেরা, পাসপোর্টসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবি, মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মালমাল জব্দ করা হয়।

প্রতারক হিসেবে শাহিরুলের উত্থান

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ শাহীরুলের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি সৌখিন পরিবহনে কাজ করেন বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

এরপর অতি অল্প সময়ে অধিক টাকার মালিক হওয়ার লোভে তিনি প্রতারণার পথে পা বাড়ান বলে জানান র‌্যাব কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক।

তিনি জানান, ২০০৩ সাল থেকে শাহীরুল শুরু করেন নিরাপত্তা কর্মী সরবরাহ। এরপর ধীরে ধীরে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিস লিমিটেডের নামে শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রতারণা।

“এরপর থেকে অবৈধ সম্পদের মালিক হতে শুরু করেন তিনি। তার কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার নামে অগণিত মানুষের নিকট থেকে টাকা নিলেও কাজ দেননি। আত্মসাৎ করেছেন বিপুল পরিমাণ টাকা।“

ঊর্ধ্বতন এ র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, প্রতারণার নানান অভিযোগ আড়াল করতে শাহীরুল তার অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করেন।

হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সার্ভিসের মালিকের পাশাপাশি নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি বেনামি মানবাধিকার সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবও পরিচয় দেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, “ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সে নামকরা  ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো প্রদর্শন করে এবং বিভিন্ন কাজে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম  ব্যবহার করে।

শাহীরুল প্রতারণার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী ও পুরুষকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড, ড্রাইভার, কম্পিউটার অপারেটর, অফিস সহকারী, বিক্রয় কর্মকর্তা, লাইনম্যান ইত্যাদি হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

প্রতারণার কৌশল

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, শাহীরুল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে চাকরির চটকাদার বিজ্ঞাপন দিতেন।

শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আবেদন করলে তাদেরকে কৌশলে ভুল বুঝিয়ে তার পরিচালিত কোম্পানির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিতেন।

এ জন্য প্রতি চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা জামানত হিসেবে নিতেন। এছাড়া প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্ম ও আনুষঙ্গিক খরচ হিসেবেও টাকা নেওয়া হত।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে নিতেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা।

এভাবে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নামমাত্র কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়ে বাকি ভুক্তভোগীদের টাকা আত্মসাৎ করে শাহীরুল।

র‌্যাব ৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, দীর্ঘদিন তার অফিস ও বাসায় ঘোরাঘুরির পরও চাকরি না পেয়ে ভুক্তভোগীরা পাওনা টাকা ফেরত চাইলে তার কাছে থাকা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে তাদের বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতেন।

শাহিরুল নিজেকে একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবেও ভুয়া পরিচয় দিতেন। অনেক কর্মকর্তার সই স্বাক্ষর নকল করে আসছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন,  “সে নিজেকে শুটিং ক্লাবের সদস্য বলেও পরিচয় দিত।“

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতারণার কৌশল হিসেবে 'হোমল্যান্ড হাউজিং অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড' নামের আরও একটি কোম্পানি খোলেন তিনি। বেশ কয়েকজন মানুষকে ফ্ল্যাট ও প্লট দেওযার কথা বলে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।

শাহীরুল ইসলাম বাংলাদেশ আউট সোর্সিং অ্যান্ড পাওয়ার সাপ্লাইয়ার্স অ্যাসোশিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও নিজেকে জাহির করে অধিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় দিয়ে অর্থ আত্মসাতের করতেন এবং যাতে কেউ মুখ খুলতে না পারে সেজন্য ভয়ভীতি দেখাতেন বলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান।

মোজাম্মেল হক জানান, তার প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি অনুমোদন নেই এবং প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কোনো অফিসিয়াল সাইনবোর্ড নেই।

তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অস্ত্র আইনে পৃথক মামলা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।