দোষারোপ বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীদের চিহ্নিত করুন: আসক

সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দোষারোপের রাজনীতি বাদ দিয়ে দায়ীদের চিহ্নিত করতে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2021, 08:06 PM
Updated : 21 Oct 2021, 08:06 PM

বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘শারদীয় দুর্গোৎসবে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় জড়িতদের বিচার এবং কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের দাবিতে’ এক সংবাদ সম্মলনে এ দাবি জানানো হয়।

আসকের জ্যোষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল কবির বলেন, “এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটলেই আমরা দেখি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে দোষারোপ করতে শুরু করে, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

“দোষারোপের রাজনীতি পরিহার করে ঘটনার পেছনে যারাই থাকুক না কেন, সরকারের দায়িত্ব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।”

গোয়েন্দা ব্যর্থতার দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, “যেখানে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে কার্যত ব্যর্থ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।”

সংবাদ সম্মেলনে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে গত ১৩ থেকে ২০ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সংহিসতার একটি পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয়।

আসক জানায়, কুমিল্লায় শুরুর পর ১৩ থেকে ২০ অক্টোবর দেশের ১৮টি জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এসব সহিংসতায় ৭ জনের মৃত্যু, কমপক্ষে ২৭৪ জন আহত হয়। প্রতিমা, পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ৭২টি, ৭৭টি বাড়িঘরে ও ৪১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

সহিংসতার ঘটনা নিয়ে আসকের প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, সহিংস হামলার ঘটনার সময় ‘৯৯৯’ এ ফোন করেও কোনো কোনো এলাকায় যথাসময়ে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এছাড়া সহিংসতার ঘটনার সূত্রপাতের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে আশঙ্কার কথা জানানো হলেও তা গোচরে নেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে আসকের নির্বাহী পরিষদের মহাসচিব মো. নূর খান, নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল, পরিচালক (কর্মসূচি) নীনা গোস্বামী উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরে আসক।

>> দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় অবিলম্বে জাতীয় সংসদে বিশেষ অধিবেশন আহবান করা এবং জাতীয় পর্যায়ে করণীয় নিধারণ করা।

>> সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে একটি গণশুনানীর আয়োজন করে প্রতিটি ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা। ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুননির্মাণ করাসহ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে চিকিৎসাসহ অন্যান্য জরুরি প্রয়োজন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুর্নবাসন নিশ্চিত করা।

>> সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

>> সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ, হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও পূজামণ্ডপের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ‘ব্যর্থ স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী’ বাহিনীর ভূমিকা নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। কেবল বদলি নয়, দায়িত্বে অবহেলা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া।

>> ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারে ফেইসবুক, ইউটিউব, টুইটারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

>> সাম্প্রদায়িক হামলা ও উগ্রবাদ প্রতিহত করতে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, প্রযুক্তিবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও পেশাজীবীসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা; যারা স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী করণীয় নির্ধারণ করবে।

রাজনৈতিক কারণে এই সাম্প্রদায়িকতা: পঙ্কজ ভট্টাচার্য

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতাই দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য দায়ী বলে মনে করেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।

তিনি বলেছেন, “আজকে রাজনীতিবিদদের এটা মাথা নত করে স্বীকার করে নিতে হবে যে, এটা রাজনৈতিক ব্যর্থতা। তাদের বলতে হবে, রাজনীতির কারণে এই সাম্প্রদায়িকতার আমদানি।”

বৃহস্পতিবার বিকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে ‘সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন’ আয়োজিত এক মানববন্ধনে তিনি একথা বলেন।

প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, “সাম্প্রদায়িকতা এমনি এমনি হয় না, রাজনীতিবিদরা এটা পৃষ্ঠপোষকতা করে। বিএনপি-জামায়াত আশ্রিত, তেমনিভাবে আওয়ামী লীগ হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতা করে, পাঠ্যপুস্তকে কোমলমতি শিশুদের সাম্প্রদায়িক বানানোর প্রস্তাব মেনে নিয়ে, বাংলাদেশকে কি আর মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ রাখা গেল?”

রাজনীতিকে ‘সংশোধন’ করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বিএনপির আমলে আমরা দেখলাম ভোলাসহ ৩৩টি জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হলো, বিএনপি সেটা অস্বীকার করে বলল কিছুই হয়নি।

“আজকে মুক্তিযুদ্ধের সরকার প্রায় এক যুগের বেশি এক নাগাড়ে শাসন করছে দেশ, সেই সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধ আজ পদদলিত হবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভুলণ্ঠিত হবে, এটা মানতে বাধ্য করা হবে, হলে এই দেশ আফগানিস্থান হবে কবে?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “অনেকে বলেন এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমি এর সঙ্গে দ্বিমত করি বলছি, এটা হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন ঘটনা। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট দেখুন, যখন মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার সরকার ক্ষমতায়, তখন গত নয় বছরে সনাতন ধর্মালম্বীদের উপর ৩৬৭৯টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

“হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি বছর ৪০০ টি ঘটনা ঘটেছে। তার মানে প্রতিদিন কোথাও না কোথাও কোনো সংখ্যালঘু নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। এর বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ করলে হবে না, সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য এম এ সবুর, “সাম্প্রদায়িকতা পুষে, হেফাজতকে মদদ দিয়ে স্কুল কলেজে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে, শুধু আরবি জানার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রির সমমানের মর্যাদা দিয়ে দেশকে অসাম্প্রদায়িক করা যাবে না।”