‘বর্ণবাদী’ আচরণের শিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী:  টিআইবি

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহায়তাসহ সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ ‘বর্ণবাদী’ আচরণের শিকার হন বলে এসেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2021, 04:17 PM
Updated : 21 Oct 2021, 04:17 PM

বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ‘সরকারি সেবায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিগম্যতা: জবাবদিহি ব্যবস্থার বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসেবে- আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত, কাদিয়ানী, বাউল সম্প্রদায়, অভিবাসী রোহিঙ্গা, বিহারী, বেদে, ছিন্নমূল জনগোষ্ঠী, হিজড়া, সমকামীসহ অন্যদের মাঝে এই গবেষণা চালানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুরা স্কুলে ‘মূলধারার’ সহপাঠী ও শিক্ষকদের ‘বর্ণবাদী’ আচরণের শিকার হয়। এ বিষয়ে অভিযোগ করেও সমাধান পাওয়া যায়নি, উল্টো বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয়।

২০২০ সালের অক্টোবর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির গবেষক মো. মোস্তফা কামাল গবেষণা প্রতিবেদনের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় কম ত্রাণ পেয়ে অভিযোগ করার কারণে আদিবাসী পরিবারের ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার মত ঘটনাও এ গবেষণায় পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে টিআইবি।

‘উচ্চ বর্ণের’ হিন্দুদের প্রতিরোধে একটি শ্মাশানে দলিত ব্যক্তির লাশ দাহ করতে দেওয়া হয়নি জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযোগ জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভিন্ন শ্মাশানে লাশ দাহ করতে বলেন। এছাড়া দলিতদের খাবার হোটেলে প্রবেশ ও বসে খাবার খেতে বাধা দেওয়ার মত ঘটনাও এসেছে।

শিক্ষা, ভূমি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করা হলেও আদিবাসী পরিচয়ের কারণে তা রেজিস্ট্রারে না তুলে সংরক্ষণ এবং ফলোআপ না করার উদাহরণ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

শিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘মূলধারার’ সহপাঠী ও শিক্ষকদের ‘বর্ণবাদমূলক আচরণ’ নিয়ে অভিযোগ করে সমাধানের পরিবর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবককে শিক্ষকদের বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়েছে ভুক্তভোগীকে।

একটি ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলিত শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষাগারের সরঞ্জাম ধরতে দেওয়া হয়নি, ব্যবহারিক পরীক্ষাগারের ওই শিক্ষককে অভিভাবকরা অভিযোগ জানিয়েছিলেন।

জবাবে ওই শিক্ষক বলেন, “আপনাদের (দলিত জনগোষ্ঠীর) সন্তানরা ভালোভাবে ব্যবহারিক পরীক্ষা করতে পারে না। অন্যরা তো ঠিকই বলেছে, ভালো হয় আপনাদের সন্তানরা যন্ত্রপাতি না ধরে অন্যরা কীভাবে পরীক্ষা করে তা দেখুক।”

দলিত এক শিক্ষার্থীর বাবার পেশা ও বর্ণ পরিচয় নিয়ে ‘মূলধারার’ এক শিক্ষার্থী কটূক্তি করলে অভিভাবকের পক্ষ থেকে তার প্রতিকার চেয়ে অভিযোগ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে টিআইবি জানিয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে শিক্ষক বলেন, “আমি কী করতে পারি? আমি তো ওদের এইসব শিক্ষা দেই না। আর ওরা তো বাচ্চা, ওরা এসব বলতেই পারে।”

শিক্ষার্থীদের দিয়ে বিদ্যালয়ের শৌচাগার পরিষ্কার করানোর প্রতিবাদের কারণে দলিত শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অকৃতকার্য করার অভিযোগও রয়েছে প্রতিবেদনে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি উপজেলা শিক্ষা এবং সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তারা ওই অভিভাবকদের ‘হুমকি দেন’, সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে তা ভালো ফল বয়ে আনবে না।

সরকারি সেবায় বর্ণবাদমূলক আচরণের ঘটনা কেমন পাওয়া গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “আমাদের গবেষণা পরিসংখ্যানগতভাবে ছিল না। সরকারি সকল সেবার ক্ষেত্রে বর্ণবাদমূলক আচরণ পরিসংখ্যান দিয়ে বলা যাবে না।

“তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি যে, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেও সুরাহা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বর্ণবাদের মানিসকতা গোড়াতেই রয়েছে, যা উদ্বেগজনক।”

সমতলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুপেয় পানি, স্যানিটেশন ও সরকারি টিকাদান কর্মসূচিতে তদারকির ঘাটতির কারণে স্থানীয়ভাবে ডায়রিয়া ও হামের প্রকোপ দেখা যায় বলে তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।

ওই প্রকোপকে স্থানীয়ভাবে ‘অজানা অসুখ’ আখ্যায়িত করে তদারকির ঘাটতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ ‘বদলি’ করা হয়ে থাকে বলে জানিয়েছে টিআইবি।

গবেষণায় সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট উপাত্তের অনুপস্থিতি তাদের প্রতি উদাসীনতা ও অবজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। এটা তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা।”

আইনি সীমাবদ্ধতা বা আইনের অনুপস্থিতি, আইনের যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সেবার সুযোগ পেতে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বাধার মুখে পড়েন বলে জানায় দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি এ সংস্থাটি।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক, পেশাগত ও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে শ্রেণি পরিচয়ের হিসাবে কমপক্ষে তিন কোটি প্রান্তিক মানুষের বসবাস।

“গবেষণায় আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সার্বিক চিত্র উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। তবে এই গবেষণা পরিসংখ্যানগত ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রান্তিক পর্যায়ে মূলধারার মানসিকতা তুলে ধরা।

“আসলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক সেবা নিশ্চিতে জবাবদিহি ব্যবস্থা শক্তিশালী করা না হলে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্টের কাউকে পেছনে না রাখা হলে লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে বলে মনে করি।”

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ গবেষণাটি ছিল ‘গুণবাচক ও পরিমাণবাচক’। এর তথ্য সংগ্রহে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবাগ্রহীতাদের সাক্ষাৎকার, সংশ্লিষ্ট মুখ্য তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার ও নথিপত্র বিশ্লেষণ করা হয়।