সোজা পথে দুর্ঘটনা বেশি, কারণ অতিরিক্ত গতি: সমীক্ষা

সড়কের বাঁকগুলোকে দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও গবেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Oct 2021, 11:39 AM
Updated : 21 Oct 2021, 04:06 PM

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা দেখছেন, সোজা সড়কেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে, আর মূল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো।

মহাসড়কে বিভাজক বসানোয় গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ কমলেও পেছন থেকে ধাক্কার ঘটনা বেড়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান।

‘নিরাপদ সড়ক দিবস’র আগের দিন বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক এক সংলাপে নিজেদের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন তিনি।

এদিন আরেক অনুষ্ঠানে যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক পরিসংখ্যানে জানায়, গত ছয় বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

হাদিউজ্জামান বলেন, “অনেকের ধারণা সড়ক বাঁকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু জরিপ করে দেখা গেছে বাঁকে দুর্ঘটনা ঘটে ৩০ শতাংশ, আর বাকি সব দুর্ঘটনা ঘটে সরল বা সোজা সড়কে।”

এজন্য গাড়িগুলোর অতিরিক্ত গতিতে চালানোকে দায়ী করার পাশাপাশি কেন চালকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন, তার ব্যাখ্যাও দেন তিনি।

“সারাদেশের সড়কগুলোর উপর দুইশর বেশি হাট ও বাজার রয়েছে। এই হাটবাজারের যানজটে পরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় চালককে। ওই চালকরা যখন গাড়ি নিয়ে সরল পথে আসে, তখন যানজটে নষ্ট হওয়ার সময় পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায়।”

এই অতিরিক্ত গতি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন বলে জানান এই অধ্যাপক।

“সমীক্ষা করে দেখা গেছে ৩০ শতাংশ গতিতে চলমান কোনো গাড়ির ধাক্কায় আঘাত পেয়ে আহত হলে বাঁচার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ। কিন্তু ১০ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ৪০ গতির গাড়ির ধাক্কায় আঘাত পেয়ে আহত হলে বাঁচার সম্ভাবনা ৪৫ শতাংশে নেমে আসে আর ৫০ শতাংশ গতির গাড়ির ধাক্কায় আহত বাঁচার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ নেমে আসে।”

“সুতরাং গতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাপকাঠি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে,” বলেন হাদিউজ্জামান।

দেশের অধিকাংশ মহাসড়কে বিভাজক বসানোয় গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ কমানো গেলেও দুর্ঘটনার ধরন এখন পাল্টে গেছে বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে।

“এখন পেছন থেকে ধাক্কার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে,” বলেন হাদিউজ্জামান।

নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে কুয়াশার কারণে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয় বলেও জানান তিনি।

এই সংলাপে ড্রাইভার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাদল আহমেদ গাড়িচালকের সঙ্কটের কথা তুলে ধরে বলেন, তার সমাধান না হলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।

তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, “চালকের চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই। গাড়ির একটি অংশ খারাপ এবং এই গাড়ি নিয়ে যেতে পারব না- মালিককে বললেই মালিক বলে ‘চাবি দাও’; সঙ্গে সঙ্গে অন্য চালককে চাবি দিয়ে দেয়। এটা কোন ধরনের নিরাপত্তা? আর ১৭ ঘণ্টা গাড়ি চালালে কী থাকে শরীরে?”

বাদল বলেন, “৩ লাখ টাকা খরচ করে গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করায় মালিকরা, কিন্তু এক হাজার টাকায় চালাকের ফিটনেস করাতে পারে না। চালকের চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করছে না মালিক পক্ষ। চালকরা তো নিজেরাই নিরাপদ নয়, তাহলে নিরাপদ সড়ক কীভাবে আসবে?”

বাংলাদেশ সড়ক ও শ্রমিক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার ১০৫টি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে চালকের কারণে ঘটে মাত্র চারটি দুর্ঘটনা। কিন্তু সব দুর্ঘটনায় চালককেই সবাই দোষারোপ করে থাকে।”

সংলাপে আবুল বাশার নামে একজন প্রশিক্ষক বলেন, চালক নিরাপদ থাকলে, মালিক থেকে শুরু করে সবাই নিরাপদ থাকবে।

বিআরটিএর সহকারী পরিচালক শহীদুল আযমও চালকের প্রশিক্ষণের উপর জোর দিয়ে বলেন, সরকার চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে। আগামী তিন বছরে এর সুফল পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা, ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের কারণে কয়েক মাস লকডাউন থাকার পরেও যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে তাকে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।

তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইন, নীতিমালা ও পরিকল্পনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ ও ড্রাইভার্স ট্রেইনিং সেন্টার আয়োজিত এই সংলাপে সঞ্চালনায় ছিলেন সাংবাদিক পার্থ সারথি দাস।