তিন দিনে ৭০ পূজামণ্ডপে হামলা: ঐক্য পরিষদ

দুর্গাপূজায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তিন দিনে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর-লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Oct 2021, 03:23 PM
Updated : 16 Oct 2021, 03:52 PM

শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত লিখিত বক্তব্যে এসব তথ্য তুলে ধরে জানান, এসবের বাইরে ৩০টি বাড়ি এবং ৫০টি দোকানেও ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে।

তিনি বলেন, “এর মধ্যে ১৩ অক্টোবর হাজীগঞ্জের লক্ষ্মীনারায়ণজি আখরায় আক্রমণ চলাকালে মানিক সাহা নামে একজন মৃত্যুবরণ করেছেন।

“১৫ অক্টোবর নোয়াখালীতে বিজয় পূজামণ্ডপের সদস্য যতন সাহাকে সাম্প্রদায়িক হামলাকারীরা পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। ইসকন মন্দিরের প্রভু মলয় কৃষ্ণ দাসের মাথায় আঘাত করে তাকে নির্মমভাবে খুন করেছে।”

এছাড়া তিনি শনিবার সকালে ইসকন মন্দিরের সামনের পুকুরে আরও এক ভক্তের লাশ ভেসে উঠার কথাও জানান, যার নাম পার্থ দাস বলে ইসকন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

দুর্গাপূজা ঘিরে তিন দিনের হামলা ও সহিংসতার তথ্য সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত।

তবে যতন সাহার ‘হৃদরোগে’ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন বলে নোয়াখালী পুলিশের ভাষ্য। পার্থর মৃত্যু হামলায় হয়েছে কিনা তা তারা নিশ্চিত করতে পারেনি। আর মলয় কৃষ্ণর মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশের কাছ থেকে কোনো তথ্যই মেলেনি।

হাজীগঞ্জে মানিক সাহার নিহত হওয়ার বিষয়েও চাঁদপুর পুলিশের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এসব হামলার ঘটনায় আরও কমপক্ষে ৭০ জন আহত হয়েছেন বলে রানা দাশগুপ্ত জানান।

সাম্প্রদায়িক হামলার এসব ঘটনার মধ্যে এক হিন্দু কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছেন বলে শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

কেউ কেউ বলছেন ঘটনা চাঁদপুরের, কেউ নোয়াখালীর কথা বলছেন। তবে এই খবরের সত্যতা মেলেনি।

এবিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাণা দাশগুপ্ত বলেন, “ধর্ষণের কোনো খবর আমাদের জানা নেই।”

কুমিল্লায় ১৭ চাঁদপুরে ১৬ মণ্ডপে হামলা

রানা দাশগুপ্ত জানান, ১৩ অক্টোবর অষ্টমীর দিন কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর উত্তর পাড় দর্পন সংঘের অস্থায়ী মণ্ডপে এবং চানমনি কালী বাড়ির বিগ্রহ ও মণ্ডপে অগ্নিসংযোগসহ ১৭টি মণ্ডপে তোরণ ভেঙে দেওয়া হয়।

১৩ অক্টোবর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে যেসব মন্দিরে হামলা হয় সেগুলো হলো- ত্রিনয়নী সংঘের পূজামণ্ডপ, লহ্মীনারায়ণজী আখড়া, রামকৃষ্ণ মিশন, জমিদারবাড়ি দুর্গা মন্দির, শ্মশান কালী মন্দির, নবদুর্গা সংঘ পূজামণ্ডপ, দশভূজা সংঘ পূজা মণ্ডপ, সোনাইমুড়ি গ্রামের পূজামণ্ডপ, হাজীগঞ্জ শহর পূজামণ্ডপ, রামপুর লোকনাথ মন্দির, ভদ্রকালী মন্দির, ত্রিশুল সংঘ পূজামণ্ডপ, রামপুর বলক্ষার বাজার পূজামণ্ডপ, হাজীগঞ্জ রাধাগোবিন্দ মন্দির, বাজারগাঁও মুকুন্দ সাহার বাড়ির দুর্গা মন্দির, হাটিলা গঙ্গানগর দুর্গা মন্দির।

কুমিল্লার কাপড়িয়াপট্টি শ্রী শ্রী চান্দমনি রক্ষাকালী মন্দিরে হামলায় মূল ফটক তছতছ হয়ে যায়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

এছড়া হাতিয়ায় ৭টি মন্দিরে ভাঙচুর হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।  সেগুলো হলো- শংকর মার্কেটের আশুতোষ ডাক্তার বাড়ির পূজামণ্ডপ, জগন্নাথ মহাপ্রভুর সেবাশ্রম পূজা মন্দির, রাধাগোবিন্দ সেবাশ্রম পূজা মন্দির, শ্রী লোকনাথ মন্দির পূজামণ্ডপ, তপোবন আশ্রম পূজা মন্দির, গুরুচাঁদ সত্যবামা পূজা মন্দির, হাতিয়া পৌরসভা কালী মন্দির এবং তার কাছাকাছি ৪-৫টি ঘরও ভাঙচুর করা হয়।

অষ্টমীর দিনে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি সীতারাম ঠাকুর সেবাশ্রম, গাজীপুরের কাশিমপুর সুবল দাশের মন্দির ও কাশিমপুর বাজার কালী মন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়।

একই দিনে কুড়িগ্রামের উলিপুর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, হবিগঞ্জের বাহুবল, সিলেটের জকিগঞ্জের কালিগঞ্জ বাজার ও ভোলার নবীপুরে বেশ কয়েকটি মন্দির, পূজামণ্ডপে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।

হামলার সময় ঘরবাড়ি-দোকান লুট

অষ্টমীর দিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার শেখেরখীল ও নাপোড়া গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয়।

শেখেরখীলের মোহাম্মদ সাবের আহমেদ, গণ্ডামারার মোহাম্মদ রিদোয়ান ও নাপোড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম এসব হামলায় নেতৃত্ব দেন বলে রানা দাশগুপ্ত অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, “সেদিন শেখেরখীল সার্বজনীন মন্দির ধ্বংস করা হয়। হরি মন্দিরের সামনের সড়কে হিন্দুদের ২০টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। শেখেরখীল সার্বজনীন মহাশ্মশানের সীমানা প্রাচীর ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। নাপোড়ায় সার্বজনীন কালীবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”

নাপোড়া বাজার থেকে কালীমন্দির পর্যন্ত সড়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩০টি দোকান ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলেও লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়।

হামলায় শেখেরখীলে সুকুমার দাস, সমীর দেব, দুলাল দেব, জুয়েল শীল ও লিটন দেব এবং নাপোড়ায় জহর লাল দেব, রতন শিকদার, আশুতোষ দেব, অনুপম দেব, জগদীশ পাল ও বোটন দেব আহত হন বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়।  

বাঁশখালীর পশ্চিম চাম্বল বাংলাবাজার করুণাময়ী কালীবাড়ির সার্বজনীন পূজা কমিটির দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর করে মন্দিরের তৈজসপত্র লুট করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এসময় প্রদীপ দাস, রঞ্জিত দাস, সবিতা বালা আহত হন।

এছাড়া শীলকূপে দাস পাড়া সার্বজনীন দুর্গা মণ্ডপ, কৈবল্য যুব সংঘ পূজামণ্ডপ ও শীলপাড়া পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় বলে তথ্য দেওয়া হয়।

১৩ অক্টোবর রাতে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার শীলখালীর দুটি পূজামণ্ডপে প্রতিমা এবং স্থানীয় হরিমন্দিরে লুটপাট ও ভাঙচুরের পাশাপাশি ১৬টি বসতঘরও লুট করা হয়।

এছাড়া মগনামা ইউনিয়নের ১২টি ঘর ভাঙচুর ও লুটপাট করে একটি ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। স্থানীয় সরস্বতী মন্দিরে দুর্গা প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। পেকুয়া সদর, বারবাকিয়া ইউনিয়ন এবং চকরিয়ায় ৫টি মণ্ডপ ও স্থানীয় লোকনাথ মন্দিরে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। 

কর্ণফুলীতে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হামলা

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ১৪ অক্টোবর বান্দরবানের লামা উপজেলার লামাবাজারে কেন্দ্রীয় হরিমন্দিরে দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলা চালিয়ে মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে।

এই হামলায় ৫০ জন আহত হন। এর মধ্যে গুরুতর ১০ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং ৮ জন ‍ডুলহাজারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানান রানা দাশগুপ্ত।

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, “১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী থানার জুলধা জেলেপাড়া পূজামণ্ডপে স্থানীয় জয়বাংলা ক্লাব থেকে এসে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া স্থানীয় দুই ভাই জয়নাল ও মনিরের নেতৃত্বে এই হামলা হয়।

“স্থানীয় ওসি দুলাল মাহমুদ হামলা হতে পারে এমন খবর আগে থেকে জানা স্বত্ত্বেও হামলা প্রতিরোধে কোনো রূপ ব্যবস্থা নেয়নি।”

১৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের সার্বজনীন দুর্গা মন্দির ও হরিমন্দিরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর চৌমুহনীতে রাধামাধব মন্দির, ইসকন মন্দির, রাম ঠাকুর মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মঙ্গলা পূজামণ্ডপ, রাম ঠাকুর পূজামণ্ডপেও হামলা করা হয়।

সবশেষ ১৫ অক্টোবর নগরীর জেএম সেন হলে চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের পূজামণ্ডপে হামলা চালানো হয়। একই সময় নগরীর হাজারী গলি, দেওয়ানজি পুকুর লেইন ও রাজাপুকুর লেইনে হামলার চেষ্টা হলেও স্থানীয়দের প্রতিরোধে তা ব্যর্থ হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়।

১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার অষ্টমীতে কুমিল্লার একটি মন্দিরে কথিত ‘কোরআন অবমাননার’ অভিযোগ তুলে বুধবার কয়েকটি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর চালানো হয়। এর পর দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দিরে ও পূজামণ্ডপে হামলা হয়। তা ঠেকাতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে।

আরও পড়ুন: