আবারও ফেইসবুক

কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা; ঘটনার ছবি-ভিডিও সঙ্গে সঙ্গে ফেইসবুকে ছড়ানোর দিকে ইঙ্গিত করে তাদের এই দাবি।

নিজস্ব প্রতিবেদকমেহেরুন নাহার মেঘলাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2021, 06:23 PM
Updated : 13 Oct 2021, 06:23 PM

বিষয়টি নজরে আসার পর সোশাল মিডিয়ায় ‘অপপ্রচার’ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

এর আগে কক্সবাজারের রামুসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে উসকানি দেওয়ার ক্ষেত্রেও ফেইসবুকসহ সোসাল মিডিয়ার ভূমিকা ছিল সমালোচিত।

কুমিল্লায় বুধবার সকালে একটি মন্দিরে কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগের ছবি-ভিডিও ফেইসবুকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর মন্দিরে হামলা হয়, যা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও বাঁধে।

কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীর পাড়ে একটি পূজামণ্ডপের ঘটনার সূত্রপাত হলেও এরপর বিকাল পর্যন্ত আরও কয়েকটি মন্দিরে হামলা হয় বলে দাবি করেন কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন কমিটি সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ দত্ত।

সোশাল মিডিয়ায় এই ঘটনার ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারেও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে প্রাণহানির খবরও পাওয়া গেছে।

শিবু প্রসাদ দত্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভিডিও করে সকাল ৬টার মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ বলার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “কারণ ৭টার সময় অনেক লোক, ওই লোকগুলো আসল কোথা থেকে, আর ওসিকে ৯৯৯ এ কে টেলিফোন করল। ওসি সাহেব অনেক চেষ্টা করছে, তখন কে বা কারা এটা ভিডিও করে ভাইরাল করে দিয়েছে।”

ওসির কুরআন উদ্ধারের ভিডিও বিভিন্ন ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট ও পেইজ থেকে ছড়াতে দেখা গেছে, যেখানে ছবি-ভিডিওর সঙ্গে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্যও দেখা গেছে।

যা তুলে ধরে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ানোর বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফেইসবুক কর্তৃপক্ষেরও সমালোচনা করেছেন অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন অনেকে।

কুমিল্লায় উত্তেজনার পর সহিংসতা।

কুমিল্লার ঘটনায় তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘটনার পরপরই এ বিষয়ে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।

“ইতোমধ্যে ১০০ এর বেশি ফেইসবুক লিংক বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি, এগুলো বন্ধ হয়ে যাবে|”

অন্যান্য সোশাল মিডিয়া থেকেও উসকানিমূলক কন্টেন্ট সরাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় আমরা এবার তাৎক্ষণিকভাবে উদ্যোগ নেওয়ায় ডিজিটাল মাধ্যমে অপপ্রচার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছি।”

“কুমিল্লার ঘটনার পরপরই ওই এলাকার ইন্টারনেট গতিতেও নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে, যাতে অপ্রপ্রচারকারীরা এসব ঘটনা ছড়ানোর সুযোগ না পায়,” বলেন তিনি।

এর আগে ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায় মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা-ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল একটি ফেইসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করেই।

২০১২ সালের শেষ দিকে ফেইসবুকে কথিত কুরআন অবমাননার ছবি ছড়িয়ে তাণ্ডব চালানো হয় কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধ বসতিতে। সে সময় ১২টি বৌদ্ধমন্দির এবং বৌদ্ধদের ৩০টি বাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেইসবুকে গুজবের সূত্র ধরে রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে আক্রমণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

গত বছর কুমিল্লার মুরাদপুর এবং এর আগে একই জেলার হোমনা, পাবনার সাঁথিয়া, সাতক্ষীরার ফতেহপুরে ফেইসবুকে গুজব থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়ায়।

কুমিল্লার ঘটনার পর বাঁশখালীতে মন্দিরে ঢিল ছুড়ে প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।

কুমিল্লায় বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লা জেলা পুলিশ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে, এছাড়াও পুরো বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি। কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে গুজব ছড়ালে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউ এমন ঘটনায় জড়িত বলে তিনি বিশ্বাস করেন না।

“বাংলাদেশে আগেও এধরণের ঘটনা ঘটেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো লোক এ ধরণের ঘটনার সাথে জড়িত, এমন নজির পাওয়া যায়নি। এটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে।”

বাম গণতান্ত্রিক জোট এক বিবৃতিতে বলেছে, “অতীতে বিভিন্ন সময়ে যেমন নানা অজুহাত তৈরি করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি এবারেও পূজামণ্ডপে কল্পিত কুরআন শরিফের অবমাননার গুজব ছড়িয়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে।”

বাঁশখালীতে মন্দিরে ঢিল ছুড়ে প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে কুচক্রী মহল সক্রিয় দাবি করে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এদিকে দুর্গাপূজার মধ্যে এই ঘটনার পর ধর্ম মন্ত্রণালয় এক জরুরি ঘোষণায় সম্প্রীতি বজায় রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

এতে বলা বলেছে, “কুমিল্লায় পবিত্র কুরআন অবমাননা সংক্রান্ত খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। খবরটি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যে আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করেছি।

“ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যে কেউ এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকুক, তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কুমিল্লায় ইতোমধ্যে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।