কুমিল্লায় বিজিবি মোতায়েন, ঘটনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ

কুমিল্লায় কুরআন অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে উত্তেজনার মধ্যে জেলা শহরে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আর সেখানে কী ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Oct 2021, 01:25 PM
Updated : 14 Oct 2021, 05:06 AM

বুধবার সকালে কুমিল্লায় একটি মন্দিরকে কেন্দ্র করে সোশাল মিডিয়ায় নানা ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এক পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ পরিস্থিতি শান্ত করতে গেলে তারাও তোপের মুখে পড়ে, বাঁধে সংঘর্ষ।

এরপর দুপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।

পরিস্থিতির বিষয়ে জা্নতে চাইলে বিজিবির কুমিল্লা ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফজলে রাব্বি বিকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লায় যাতে কোনো ধরনের ‘আনরেস্ট’ পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেজন্য দুপুরে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।”

কী হয়েছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঘটনা কী হয়েছে, তা আমি জানি না। তবে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন কথা শুনেছি এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ যাতে না ঘটতে পারে, সেজন্য বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।”

দুপুরের পর পরিস্থিতি শান্ত হলেও এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পুলিশের কর্মকর্তাদের কেউ কিছু বলতে চাননি।

এদিকে দুর্গাপূজার মধ্যে এই ঘটনার পর বিকালে ধর্ম মন্ত্রণালয় এক জরুরি ঘোষণায় বলেছে, “সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, কুমিল্লায় পবিত্র কুরআন অবমাননা সংক্রান্ত খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। খবরটি খতিয়ে দেখার জন্য ইতোমধ্যে আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করেছি।

“ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে যে কেউ এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকুক, তাদেরকে অবশ্যই আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।”

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন হাতে তুলে না নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধও জানানো হয়েছে।

এদিকে কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, কক্সবাজারের পেকুয়ায় মন্দিরে হামলার খবর পাওয়া গেছে।

ঘটনাস্থলে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা।

কুমিল্লায় নানুয়া দিঘীর পাড়ে পূজা মণ্ডপে ঘটনার সূত্রপাত হলেও এরপর সকাল থেকে বিকাল নাগাদ আরও কয়েকটি মন্দিরে হামলা হয় বলে দাবি করেছেন কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন কমিটি সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ দত্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সকাল থেকে বিকাল ৩টা নাগাদ মোট আটটি মন্দিরকে ঘিরে ভাংচুর চালানো হয়। তার মধ্যে নানুয়ার দিঘির পাড়ের দর্পনসংঘ মন্দির ও জানময়ী কালীবাড়িতে মূর্তি ভাংচুর হয়।

শিবু দত্ত বলেন, “নানুয়ার দিঘির পাড়ে এই দুর্গাপূজার অস্থায়ী মন্দির। মূল মন্দিরে হনুমানের মূর্তি থাকে না। এটার চার-পাঁচ ফুটের মধ্যে আরেকটা জায়গা করা হয়েছে রাম, সীতা ও হনুমানের ইতিহাস তুলে ধরার জন্য। সেখানে এই ঘটনা ঘটেছে।”

ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মন্দিরে কে বা কারা একটি কুরআন শরিফ রেখে গিয়েছিল।

“সকালে কে বা কাহারা এটা করছে। কেউ বলে দু’টা ভদ্রমহিলা, দারোয়ানটা নাকি ঘুমায়ে ছিল, ওই সময় ঘটছে ঘটনা। এই রকমই শোনা যাইতেছে আর কী।”

সেটাই ভিডিও করে সকাল ৬টার মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

শিবু দত্ত বলেন, “ওসি সাহেবকে কে বা কারা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করছে। ফোন করার পর ওসি সাহেব সাথে সাথে আসছে, তখন সাতটা, কি সাড়ে সাতটা বাজে। এসে উনি সাথে সাথে নিয়ে ফেলছে।”

পুরো ঘটনাটি ‘পরিকল্পিত’ দাবি করে এর তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

“পরিকল্পিত কেন? কারণ ৭টার সময় অনেক লোক, ওই লোকগুলো আসল কোথা থেকে, আর ওসিকে ৯৯৯ এ কে টেলিফোন করল। ওসি সাহেব অনেক চেষ্টা করছে, তখন কে বা কারা এটা ভিডিও করে ভাইরাল করে দিয়েছে।”

শিবু প্রসাদ বলেন, সকাল ৭টার পর থেকেই উত্তেজনা শুরু হলেও সাড়ে ১১টার দিকে ভাংচুরের শুরু হয়। র‌্যাব-পুলিশের অতিরিক্ত উপস্থিতিতে বিকাল ৩টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে।

তিনি বলেন, “আমাদের কুমিল্লাবাসীর জন্য দুর্ভাগ্য। কুমিল্লায় আমরা হিন্দু-মুসলিম সবাই ভাই ভাই হিসাবে বসবাস করে আসছি। এই ধরনের ঘটনা আমাদের এখানে কখনও হয় নাই।”

ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় বৈঠকে স্থানীয় প্রশাসন।

এদিকে সকালে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু, জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনাস্থলে যান। তার মধ্যে ইট ছোড়া চলায় পুলিশ রবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। তাতে আহত হয় অনেকে। আবার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও আহত হন ঢিলে।

হামলা ও ভাংচুরের নিন্দা

কুমিল্লায় মন্দিরে হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।

বুধবার জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “অতীতে বিভিন্ন সময়ে যেমন নানা অজুহাত তৈরি করে সংখ্যালঘুদের উপর হামালা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তেমনি এবারেও পূজামণ্ডপে কল্পিত কুরআন শরিফের অবমাননার গুজব ছড়িয়ে বিভিন্ন পূজামণ্ডপে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে।”

বিবৃতিতে কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং সারাদেশে দুর্গাপূজা নির্বিঘ্নভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানায় বাম জোট।

জড়িতরা শাস্তি পাবে: কাদের

কুমিল্লার ঘটনায় যারাই জড়িত, তাদেরকে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকার কেআইবি প্রাঙ্গণে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “যারা হিন্দুদের মন্দিরে হামলা চালায়, তারা দলীয় পরিচয়ের হলেও ছাড় দেওয়া হবে না।”

কাদের বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যারা নষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

“কোনো দুর্বৃত্ত যাতে মন্দিরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা হামলা করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।”

প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করা হবে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর ঘটনার পেছনে কী রয়েছে, তা উদ্ঘাটনের কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।

তিনি বুধবার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কুমিল্লার ঘটনা.... আমার মনে হয় কেউ ‘সাবোটেজ’ করে করেছে কি না, এটা দেখার বিষয়।

“আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এভাবে ঘটনা ঘটানোর সাহস ....বিশ্বাস হচ্ছে না। তারপরেও দেখা যাক... সবকিছু এখন কন্ট্রোল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। উদ্ধার করব প্রকৃত ঘটনা কী?”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে।”