কাদের আমার সঙ্গেও ‘প্রতারণা’ করেছে: মুসা বিন শমসের

সচিব পরিচয়ে মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার আব্দুল কাদেরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করলেও বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের দাবি করেছেন, তিনিও প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Oct 2021, 04:33 PM
Updated : 12 Oct 2021, 04:49 PM

কাদের ও স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের সঙ্গে মুসার লেনদেনের তথ্য পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশ মঙ্গলবার মুসা বিন শমসেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে এনেছিল।

ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে আসেন মুসা, কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে।

তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার অর্থ-বিত্ত নিয়ে দৃশ্যত বিভ্রান্ত হওয়ার কথা বলছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, “উনি কী ধরনের মানুষ, আমরা বুঝলাম না। তাকে আমার কাছে রহস্যময় মানুষ মনে হয়েছে।”

দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর ধরে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে কাদের চৌধুরী, তার স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়াসহ চারজনকে বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তার করা হয়।

দশম শ্রেণি পাস করা কাদেরের মূল নাম আব্দুল কাদের মাঝি। ঢাকায় এসে প্রতারণার কৌশল হিসেবে মাঝি বাদ দিয়ে চৌধুরী ব্যবহার শুরু করে নিজেকে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পরিচয় দিতেন বলে পুলিশ জানায়।

কাদেরকে গ্রেপ্তারের সময় তার সঙ্গে মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে ছবি পাওয়া যায়। কাদের দাবি করেন, তিনি মুসা বিন শমসেরের ‘আইন উপদেষ্টা’।

অভিযানের সময় কাদেরের নামে দেওয়া মুসার ২০ কোটি টাকার একটি চেকও পায় ডিবি। তাই মুসাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে আনা হয়।

মুসা, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলে জুবেরী হাজ্জাজ মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে একটি মেরুন রঙের প্রিমিও গাড়িতে ডিবি কার্যালয়ে হাজির হন। সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে তারা বেরিয়ে আসেন।

ডিবি কার্যালয়ের সামনে থাকা সাংবাদিকদের প্রশ্নে মুসা বলেন, “আব্দুল কাদের একজন মিথ্যাবাদী। আমিও প্রতারণার স্বীকার হয়েছি।”

কাদেরের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, “ডিবি আমাকে আব্দুল কাদেরের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এবং আমি যা যা জানি সব কিছু স্পষ্ট বলেছি। আমার বক্তব্যে ডিবি পুলিশ সন্তুষ্ট।”

ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুণ সাংবাদিকদের বলেন, “উনার দাবি, উনি নিজে প্রতারিত হয়েছেন। উনি নিজেও মামলা করবেন বলেছেন। আমরা সবকিছু তদন্ত করছি। উনি মামলা করলে সেটাও আমরা তদন্ত করব।”

কাদেরের সঙ্গে সম্পর্ক হলেও তাকে আইন উপদেষ্টা করেননি বলে দাবি করেন মুসা।

তিনি বলেন, “একজন ফ্রড লোক অতিরিক্ত সচিব পরিচয়ে ভুয়া কার্ড ছাপিয়ে আমার অফিসে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে বিভিন্ন সময় ছবি তুলেছিল এবং সে মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বসে ঊর্ধ্বতন লোকদের সঙ্গে কথা বলত। তাদের মধ্যে আইজিপি, আর্মির জেনারেলসহ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলত।

“আমার বিশ্বাস ছিল যে তিনি (আব্দুল কাদের) অতিরিক্ত সচিব। কিন্তু পরে প্রমাণিত হলো- সে অতিরিক্ত সচিব না, তিনি একজন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব। পরে তাকে বের করে দিলাম আমি।”

কাদেরের সঙ্গে ছবির বিষয়ে মুসা বলেন, “আমার সঙ্গে অনেক লোক এসে ছবি তোলে। কেউ ছবি তুলতে চাইলে আমি তাকে না করতে পারি না। আমার ছবি নিয়ে যদি কেউ প্রতারণা করে, সেটার দায়-দায়িত্ব তো আমি নিতে পারি না।”

কাদেরের সঙ্গে ২০ কোটি টাকার চেকের লেনদেনের বিষয়ে তিনি বলেন, “ওটা আমি ফেরত দিয়ে দিয়েছি।”

গোযেন্দা কর্মকর্তা হারুণ বলেন, “আমরা বহুক্ষণ তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছি। তাকে জিজ্ঞেস করেছি, কাদের নাইন পাস লোক, তাকে উপদেষ্টা বানালেন কেন? ২০ কোটি টাকার চেক দিলেন কেন? উনি বলেছেন- ‘লাভ দিবে, তাই দিয়েছি’।”

ঢাকার মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে মঙ্গলবার প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমখি হন মুসা বিন শমসের।

‘রহস্যময়’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের বেয়াই মুসা বিন শমসেরের সম্পদ আর আড়ম্বরপূর্ণ্ জীবন-যাপন নিয়ে আলোচনা দীর্ঘকালের।

জনশক্তি রপ্তানি দিয়ে মুসার ব্যবসার শুরু হলেও তার পরিচয় দিতে গিয়ে অস্ত্র ব্যবসার কথাই বেশি আসে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। বিলাসি জীবন-যাপনের কারণে বিদেশি গণমাধ্যমে অনেক সময় তাকে বলা হত ‘প্রিন্স অব বাংলাদেশ’।

১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যে নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী টনি ব্লেয়ারের নির্বাচনী প্রচারের জন্য ৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের এই ব্যবসায়ী।

একটি দৈনিকে সুইস ব্যাংকে মুসা বিন শমসেরের ৫১ হাজার কোটি টাকা থাকার খবর ছাপা হয়েছিল। তবে এসব নিয়ে ২০১৬ সালে দুদক জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল মুসাকে। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশে বসে কেউ এত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না

মুসার বিরুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা করার অভিযোগও রয়েছে, তবে মুসার দাবি, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন তিনি।

এই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তা হারুণ বলেন, “মুসা বিন সমশেরকে আমার কাছে রহস্যময় মানুষ মনে হয়েছে।

“তিনি ৮২ মিলিয়ন ডলার প্রসঙ্গে বলেছেন, সুইস ব্যাংকে তার টাকাটা আছে। তিনি আমাদের বলেছেন, ৮২ মিলিয়ন ডলার সুইস ব্যাংক থেকে পেলে তিনি পুলিশকে দেবেন ৫০০ কোটি টাকা, দুদকে বিল্ডিং করে দেবেন, দ্বিতীয় পদ্মা সেতু করে দেবেন! উনি কী ধরনের মানুষ, আমরা বুঝলাম না।”

হারুণ বলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে উনি (মুসা) অন্তঃসারশূন্য মানুষ। উনাকে একটা ভুয়া লোক মনে হয়েছে।

“উনার কিচ্ছু নাই। গুলশানে তার একটা বাড়ি আছে, সেটাও স্ত্রীর নামে। বাংলাদেশে তার নামে আর কিছু পাইনি। তবে উনি মুখরোচক গল্প বলেন। উনি বলেন, এদেশে যত উন্নয়ন হয়েছে, সেখানে তার অবদান রয়েছে। উনার যে বাস্তব অবস্থা এখন দেখলাম তিনি অন্তঃসারশূন্য, কোনো কিছুই নাই।”

তবে কাদের বিষয়ক তদন্তে মুসা ছাড় পাচ্ছেন না বলে ইঙ্গিত দেন যুগ্ম কমিশনার হারুণ।

তিনি বলেন, “এই কাদেরের সঙ্গে উনার অনেক সম্পর্ক রয়েছে। উনি তাকে ‘বাবা সোনা’ বলেই ডাকেন। কাদেরের সাথে ছেলের চেয়েও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। উনার সঙ্গে কাদের মাঝির যে সম্পর্ক, এর দায় তিনি এড়াতে পারবেন না।

“উনার সঙ্গে কাদের মাঝির যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক, তা দিয়ে বিভিন্ন মানুষকে কাদের মাঝি ঠকিয়েছেন। কাদের মাঝি বলেছেন, উনার সঙ্গে আইজিপিসহ বড় বড় মানুষের সম্পর্ক আছে। কিন্তু মুসা সাহেবের তো জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল আমাদের ইন্সপেক্টর জেনারেল বা অন্যদেরকে। উনি এগুলো জিজ্ঞাসা করেন নাই। কাদের মাঝির সঙ্গে উনার একটা যোগসূত্র রয়েছে বলেই আমাদের ধারণা।”

আরও খবর