শঙ্কায় বিকল্প আশ্রয়ের খোঁজে রোহিঙ্গা নেতারা

নিহত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহর ভাতিজা মাস্টার আব্দুর রহিম। চাচার মতো তিনিও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছেন। চাচা খুন হওয়ার পর এ রোহিঙ্গা নেতা একরকম লুকিয়ে থাকছেন, চাইছেন নিরাপত্তা।

গোলাম মর্তুজা অন্তুও শংকর বড়ুয়া রুমিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2021, 06:53 PM
Updated : 2 Oct 2021, 06:53 PM

মুহিবুল্লাহর গড়ে তোলা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচআর) সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন আব্দুর রহিম।

শনিবার দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে তিনি বলেন, “পরিবারসহ আমরা সবাই এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছি। আরসার লোকজন আমাদেরকেও হুমকি দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের কাছে এখন আমরা নিরাপত্তা চাই।

“আমাদের অন্যত্র স্থানান্তর (রিলোকেশন) করে বা অন্য কোনোভাবে সরকার যেন আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।“

শুধু রহিম নন, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর মুহিবুল্লাহর অনুসারী অন্য সংগঠকরাও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

কক্সবাজারে কাজ করে এমন দুটি এনজিওর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর অন্তত চারজন রোহিঙ্গা সংগঠক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘অ্যাসাইলাম’ (আশ্রয়) চেয়েছেন।

এআরএসপিএইচআর কার্যালয়ে গত বুধবার রাতে সংগঠনটির চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে (৪৮) গুলি করে হত্যা করা হয়। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওই সংগঠনের কেন্দ্রীয় অফিস।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ শরণার্থী শিবিরে সংগঠনটি মূলত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও যথাযোগ্য নাগরিক মর্যাদায় প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করছে। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য আরাকান রিপাবলিকান স্যালভেশন আর্মিকে (আরসা) দায়ী করে আসছেন মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীরা। তবে আরসা এ দায় অস্বীকার করেছে।

নিরাপদ ও বিকল্প আশ্রয়ের খোঁজে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (আরনো) নামে একটি সংগঠনের একজন নেতা বিভিন্ন সংস্থাকে চিঠি দিয়েছেন। নিরাপত্তার কারণে তার নামটি প্রকাশ না করতে অনুরোধ করা হয়েছে।

চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, মুহিবুল্লাহর সঙ্গে একসঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করেছেন তিনি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) ও ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে করা মামলার অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে যারা কাজ করেছে তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের পর তিনি প্রচণ্ড আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

মুহিবুল্লাহর মতো কোনো ঘটনার শিকার হওয়ার আগেই তাকে ‘অ্যাসাইলাম’ দেওয়ার অনুরোধ জানান চিঠিতে।

আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, ওই হামলাকারী অপরাধীরা প্রত্যাবাসনও চায় না, কোনো মানবাধিকার কর্মীকেও পছন্দ করে না। এমনকি রোহিঙ্গাদের কাছে সম্মানীয় বা যারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করে এমন কোনো ব্যক্তিকে তারা পছন্দ করে না। তাই তারা রোহিঙ্গা নেতাদের ‘টার্গেট’ করে হত্যা করছে। 

লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী নেত্রী জামালিদা বলেন, “মুহিবুল্লাহর সঙ্গে তিনিও প্রত্যাবাসনের কথা বলতেন। এখন খুব আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।“

মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কাজ করেছেন। মুহিবুল্লাহর সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও ছিল।

তিনি বলেন, “মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে মানুষের মধ্যে শোক-ক্ষোভ যেমন আছে। তারচেয়ে বেশি আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে তাদের।

“মুহিবুল্লাহ দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারের কথা বলেছেন। দেশে ফেরার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য চেয়ে ফিরেছেন। মানবাধিকারের বিষয়টিকে তুলে ধরেছেন, গণহত্যার বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন তিনি। হঠাৎ করে তার হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন।“

এদের অনেকেই নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতে শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই বিভিন্ন মহলে তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে এবং বিকল্প বাসস্থানের বিষয়ে অনুনয় ও আবেদন করছেন।“

নূর খান বলেন, “যারা মুহিবুল্লাহর সঙ্গে কাজ করতেন, তারা এত ভীত-সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছেন যে তারা বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছেন। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় প্রার্থনা করছেন।“

মুহিবুল্লাহর অনুসারীদের আতঙ্কের কারণ ব্যখ্যা করে তিনি বলেন, “মুহিবুল্লাহর তৎপরতা শুধু ক্যাম্পেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। দেশটির বিরোধী রাজনৈতিক জোটের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছেন তিনি।

“পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে তার সোচ্চার কণ্ঠ আমরা দেখেছি। রোহিঙ্গাদের অধিকারসহ স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনি কাজ করছিলেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যেকটা ক্যাম্পের প্রতি ব্লকে কমিটি করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের ভালোমন্দ দেখভাল করতেন। এসব নানা কারণে একাধিক পক্ষ তাকে পছন্দ করেনি। তাদের রোষ তার অনুসারীরাদের উপরও পড়বে এটাই স্বাভাবিক।“

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নইমুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এভাবে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেননি। তবে এমনিতেই ক্যাম্পের নিরাপত্তা অনকে বাড়ানো হয়েছে। আমাদের সদস্যদের সতর্ক করে দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে।

“শনিবারও ইউএনএইচসিআর এর নিরাপত্তা কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।“

উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহর অফিস। এখান থেকেই ‘হোম গোয়িং ক্যাম্পেইন’ চালিয়েছেন। ছবি: গোলাম মর্তুজা অন্তু।

অডিও প্রচারণা ও হুমকি

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর বাসিন্দাদের কাছে গণবার্তা পৌঁছাতে রোহিঙ্গা নেতারা অডিও ক্লিপ ব্যবহার করেন। এরকম কয়েকটি অডিও ক্লিপ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের হাতে এসেছে। যেখানে আরসার পক্ষ থেকে মুহিবুল্লাহকে হুমকি দেওয়ার কথা শোনা গেছে।

আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের আগের একটি অডিও ক্লিপে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক দুজন রোহিঙ্গা নেতার কথায় কাজ করলে মুহিবুল্লাহকে খুন করা হবে।

হত্যার সরাসরি হুমকি দিয়ে এ অডিওতে বলা হয়, “কালসাপের মতো করে মারব। এখন আপনার প্রাণ কই মাছের মতো আমাদের হাতেই লাফাচ্ছে। আপনার মৃত্যু কাছে এসেছে বলে আপনি এ কাজগুলো করছেন। ‘কই মাছ যেমন প্রাণ যাওয়ার আগে কূলে ওঠে’ আপনিও সেরকম কাজ করে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনছেন।”

অডিও টেপে রোহিঙ্গাদের আরেক নেতার কথা উল্লেখ করে তার কথা মতো চলতে বলা হয়।

প্রায় ছয় মাস আগের ওই অডিও ক্লিপে যাদের কথা বলা হয়, তাদের একজন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (আরনো) সংশ্লিষ্ট। 

আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের (এআরইউ) প্রেসিডেন্ট, পেনসিলভেইনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়াকার উদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় অধ্যাপক ওয়াকার এক ই মেইলে বলেন, “মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উন্নতির জন্য, বিশেষ করে শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়নে তার সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। মুহিবুল্লাহর প্রতি আমার পরামর্শ এবং নির্দেশনা ছিল শুধু তার (মহিবুল্লার আদর্শ) উপর ভিত্তি করে এবং অবশ্যই প্রত্যাবাসনের বিষয়টা ছিল।

“তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজায় দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন, যার মধ্যে শরণার্থীদের আরাকানের স্বদেশে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন অন্তর্ভুক্ত। শরণার্থী শিবিরের দুর্বৃত্তরা স্পষ্টতই মহিবুল্লার শান্তিপূর্ণ ও মহৎ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করছে এবং প্রত্যাবাসনের বিরোধিতা করছে।”

প্রত্যাবাসনবিরোধীদের উদ্দেশ্য নিয়ে অধ্যাপটক ওয়াকার বলেন, “শরণার্থী শিবির তাদের অপারেশনের ঘাঁটি হয়ে উঠছে এবং শরণার্থীদের আরাকানে তাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তন মানে তাদের অপারেশন বেস হারানো।

“এই দ্রুত বর্ধনশীল হিংস্র গোষ্ঠীগুলি মুহিবুল্লাহর মতো রোহিঙ্গা নেতাদের প্রতিটি শক্তিশালী, যুক্তিসঙ্গত এবং শালীন কণ্ঠকে নীরব করার জন্য প্রস্তুত। প্রত্যাবাসনে যত বেশি সময় লাগবে, ক্যাম্পের পরিস্থিতি তত খারাপ হবে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী তা জানে। তাই তারা তাদের বিলম্ব কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।”আরেকজন যুক্তরাষ্ট্রে আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়ন (এআরইউ) সংশ্লিষ্ট।

আরেকটি অডিও ক্লিপে ক্যাম্পের ভেতরে গিয়াসউদ্দীন নামে এক রোহিঙ্গার হত্যাকাণ্ডের জন্য মুহিবুল্লাহর অনুসারীদের দায়ী করা হয়।

ওই অডিওতে বলা হয়, গিয়াসউদ্দীনকে যেভাবে ‘কুকুরের মত করে’ খুন করা হয়েছে। মাস্টার মুহিবুল্লাহর ‘মৃত্যুও কাছে’।

আরেকটি অডিওতে বলা হয়, “বিপক্ষে যারা আছে, তাদের মুহিবুল্লাহ প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে এক হয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী সাজিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছেন। ভাঙা একটা অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসী বলে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। … এজন্য মুহিবুল্লাহর প্রতিপক্ষরা পেরেশানিতে (কোনঠাসা হয়ে) আছে।”

এসব অডিও বার্তা প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা নেতা ও মুহিবুল্লাহর ভাতিজা আব্দুর রহিম বলেন, “এসব মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে মুহিবুল্লাহকে অজনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিল আরসা।

“তবে আপনি ক্যাম্পে গিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করুন তিনি কেমন ছিলেন। এখনও মানুষ কাঁদছে।”

আরও খবর