নির্বান্ধব জীবনে অদ্ভুত এক মৃত্যু

কুইন্স পার্ক, ঢাকার পল্লবীর এই বাড়ির একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রোকনউদ্দীন। তবে প্রতিবেশী কারও সঙ্গে তার পরিবারের কারও কোনো যোগাযোগ ছিল না, যাতায়াত ছিল না সন্তানদেরও। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2021, 08:15 PM
Updated : 28 Sept 2021, 08:22 PM

রোকনউদ্দীনের লাশ উদ্ধারের পর কুইন্স পার্কে গিয়ে জানা গেল বুয়েটের অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষকের অদ্ভুত জীবনযাত্রার কথা।

পল্লবীর প্রধান সড়ক থেকে একেবারে কাছেই বাড়িটি। এর দোতলায় থাকতেন রোকনউদ্দীন। সেই ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয় রোকনউদ্দীনের লাশ; বিছানায় তার অর্ধগলিত লাশের পাশে শুয়েছিলেন স্ত্রী নিলফার ইয়াসমিন।

ওই ফ্ল্যাটের অন্য কক্ষে ছেলে শাহরিয়ার আহমেদ রূপম (৪০) থাকলেও তিনিও জানতেন না, তার বাবা মারা গেছেন দুদিন আগে।

সোমবার খবর পেয়ে রোকনউদ্দীনের (৮০) লাশ উদ্ধার এবং তা্র স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তির পর পল্লবী থানার এসআই শফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, ওই বাড়ির পরিবেশ দেখে তার ‘অস্বাভাবিক’ মনে হয়েছে।

মঙ্গলবার ওই বাড়িতে গিয়ে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বললেও এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের সমর্থন মেলে।

রোকনউদ্দীন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। দুই দশক আগে তিনি অবসরে যান।

বছর দশেক আগে পল্লবীর বাড়িটি আবাসন  নির্মাতা কোম্পানিকে দেন তিনি। নয় তলা বাড়ির পাঁচটি ফ্ল্যাট পান তিনি। বাকি চারটি বিক্রি করে দেয় ডেভেলপার কোম্পানি।

চারটি ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে একটিতে ছেলে রূপম ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন রোকনউদ্দীন। রূপম এমবিবিএসে ভর্তি হলেও সম্পন্ন করেননি। বিয়ে করলেও স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। 

ওই ভবন মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ আবদুল মান্নান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মূলত রোকনউদ্দীন শিক্ষক জেনেই তিনি এখানে ফ্ল্যাট কেনেন। কিন্তু এরপর এখানকার যাপিত জীবন খুব একটা ভালো কাটেনি।

আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষক মান্নান বলেন, রোকনউদ্দীন যেহেতু পাঁচটি ফ্ল্যাটের মালিক তাই ভবনের বিষয়ে অনেক কিছুই তার উপর নির্ভর করত। কিন্তু রোকনউদ্দীন কাউকেই বিশ্বাস করতে পারতেন না। তার নিজের ফ্ল্যাটটি পরিষ্কার করতেন না। গন্ধ বের হত বলে প্রতিবেশীরা অভিযোগ দিলেও তিনি শুনতেন না।

আবদুল মান্নান বলেন, রোকন উদ্দীন ও তার ছেলে খুব কমই ফ্ল্যাট থেকে বের হতেন। তার স্ত্রী তো বেরই হতেন না। ওই বাড়িতে কোনো গৃহকর্মীও ছিল না। প্রতিবেশী অনেকে বয়স্ক দুজনের দেখভালের জন্য একজন গৃহকর্মী রাখতে বললেও রোকনউদ্দীন কখনোই তাতে কান দেননি।

ওই ভবনে দেড় বছর ধরে তত্ত্বাবধায়কের কাজ করছেন হুমায়ুন কবীর বলেন, “স্যারদের (রোকনউদ্দীনের) বাসাটা সাড়ে ষোলশ বর্গফুট, পুরো বাসাই জঞ্জাল দিয়ে ভরা। বিছানা, মেঝে, সোফা সব জায়গায় কাগজ, বই-খাতা, বিস্কুটের প্যাকেট, সিগারেটের প্যাকেট, কফির জার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত।

“তারা নিয়মিত বাজারও করত না। হয়ত দুই মাসে পাঁচ কেজি চাল কিনত। কখনও মাছ-মাংস কিনতে দেখিনি। কারণ বাসায় রান্না করার মতো কেউ ছিল না। বেশিরভাগ সময় প্যাকেটের খাবার খেয়েই থাকত।”

মাঝেমধ্যে রোকনউদ্দীনকে নিচে নেমে বনলতার পাউরুটি, বিস্কুট, দই ইত্যাদি কিনে নিয়ে যেতে দেখতেন হুমায়ুন।

“দেখা যেত এরপর ১৫ দিন আর কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছে না। তারা বাসার ময়লাও বাইরে ফেলত না। সব বাড়িতেই জমা।”

হুমায়ুন বলেন, রোকনউদ্দীনের খাবার টেবিলটাও একটা ‘আবর্জনার স্তূপ’। একদিন তিনি গিয়ে পরিষ্কার করে দিতে চেয়েছিলেন, তবে রোকনউদ্দীন হাত দিতে দেননি।

রোকনউদ্দীনের নীল রঙের টয়োটা এলিয়ন গাড়িটি গ্যারেজেই পড়ে ছিল। হুমায়ুন জানান, মঝে-মধ্যে রূপম গাড়িটি চালিয়ে বের হতেন। আবার কিছুক্ষণের মধ্যে বাসায় ফিরে আসতেন।

রূপম পুলিশকে বলেছেন, মৃত অবস্থায় পাওয়ার দুদিন আগে তিনি তার বাবাকে তাদের ঘরে গিয়ে দেখে এসেছিলেন। তখন তার বাবা-মা শুয়ে ছিলেন। সোমবার দুর্গন্ধ পেয়ে ওই ঘরে গিয়ে দেখেন যে তার বাবা মৃত, শরীর ফুলে গেছে। পাশেই শোয়া তার মা প্রায় অচেতন।

পল্লবী থানার ওসি পারভেজ ইসলাম বলেন, রূপম পুলিশকে বলেছেন, চার দিন ধরে তিনি কিছু খাননি। নিজে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ধারণা থেকে তিনি আলাদা কক্ষে ছিলেন বলে বাবার মৃত্যুর বিষয়টি ধরতে পারেননি।

প্রতিবেশী মান্নান খান বলেন, রোকনউদ্দীনের মৃত্যুর পর মৃতদেহ পচে পুরো ভবনে গন্ধ ছড়ায়। প্রতিবেশীরা বাড়িটি পরিষ্কার করে দিতে চেয়েছিলেন। তবে রূপম তা করতে দেননি।

প্রতিবেশীরা জানান, পরিবারটি সবসময় দরজা-জানাল লাগিয়ে রাখত। কারও সঙ্গে মিশত না তারা। কোনো আত্মীয়-স্বজনকেও আসতে দেখা যেত না।

প্রতিবেশীরা সবাই জানেন, রোকনউদ্দীনের দুই ছেলে। একজন মারা গেছেন। আর রূপম বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন।

তবে পুলিশ বলছে, ওই দম্পতির পাঁচ ছেলে-মেয়ে। তবে রূপম ছাড়া বাকি তিন মেয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না।

পল্লবী থানার ওসি পারভেজ বলেন, রোকনউদ্দীনের মৃত্যুর খবর পেয়ে তার তিন মেয়ে ও এক জামাতা এসেছিলেন।

“তার জামাতা পুলিশকে বলেছেন, ১৯৯৫ সালে রোকনউদ্দীনের এক ছেলে মারা যায়। ওই সময় তিনি রোকনউদ্দীনের মিরপুরের বাড়িতে এসেছিলেন। এরপর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। যাওয়া-আসাও হয়নি কখনও। ওই জামাতা বলেন, ১৯৯৫ সালের পর তিনি এই প্রথম তার শ্বাশুড়িকে দেখলেন।”

বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক হুমায়ুন কবীরের ধারণা, কোনো কারণে রোকনউদ্দীন সবাইকে অবিশ্বাস করতেন। যার কারণে বাড়িতে কোনো গৃহকর্মী রাখতেন না, কাউকে বাজার করতে দিতেন না।

তবে কী নিয়ে রোকনউদ্দীনের এই ‘অবিশ্বাস’, কেন তাদের এই অস্বাভাবিক জীবন-যাপন, সে বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যায়নি।

রোকনউদ্দীনের মৃত্যুর কারণও জানা যায়নি।

প্রতিবেশীরা জানান, রোকনউদ্দীনকে মঙ্গলবার কালশী কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। সেখানে দুই-তিনজন আত্মীয়-স্বজন ছিলেন। আর কিছু আত্মীয় এসে রূপমকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়।

রোকনউদ্দীনের মৃত্যুর ঘটনায় পল্লবী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। তার তদন্তভার পেয়েছেন এসআই শফিকুল ইসলাম, যার দৃষ্টিতে পরিবারটি ‘অত্যন্ত অস্বাভাবিক’ জীবন-যাপন করতেন।