ভোট মোংলায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিরীহ নারী হত্যা সাভারে, অবশেষে গ্রেপ্তার

ভোটে ‘ভাগ বসাবে’ বলে নিরীহ এক নারীকে খুন করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ফাঁসানোই সহজ মনে হয়েছে মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হালিম হাওলাদের।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2021, 02:24 PM
Updated : 27 Sept 2021, 02:43 PM

এজন্য এমন একটি খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে এবং আরও দুই খুনের চিন্তাভাবনা করতে থাকে, যা সিনেমার প্লটকেও যেন হার মানায়।

হালিম হাওলাদারকে গ্রেপ্তারের পর এক সাধারণ নারী হত্যার রহস্য উদঘাটন করে এমন ভয়ংকর ঘটনাই জানতে পেরেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআই।

হত্যার ঘটনা যাতে সাড়া না ফেলে সেজন্য এমন এক নারীকে বেছে নেওয়া হয় যার স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মেয়ে থাকে দূরে গ্রামে এবং পারুল নামের এই নারী একাই থাকতেন ভোটের কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে সাভারে বলে জানান পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার।

সোমবার দুপুরে পিবিআই সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার জানান, ৭ সেপ্টেম্বর সাভারে এই খুনের পর লাভ না হওয়ায় আরও দুই জনকে খুনের করার পরিকল্পনা করেছিল ৫২ বছর বয়সী হালিম হাওলাদার নামে বাগেরহাটের মোংলার চিলা ইউনিয়নের এই সাধারণ সদস্য।

খুনের শিকার ওই নারীর মৃতদেহের পাশে পাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিল্লাল সরদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরে এই ‘সিনেমাটিক’ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে হালিমসহ তিন জনকে গ্রেপ্তার করার কথা জানান পিবিআই প্রধান।

হালিম হাওলাদার ছাড়া গ্রেপ্তার অপর দুই জন হচ্ছেন জামাল হাওলাদার ওরফে সামাদুজ্জামাল (৫০) ও দর্জি মাস্টার মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজ (৪৬)।

মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে হত্যার পরিকল্পনাকারী, খুনি এবং তার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশের এই বিশেষ ইউনিট।

বনজ কুমার বলেন, ”গ্রেপ্তার তিনজনই হত্যার দায় এবং পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

“তারা জানিয়েছে, ওই নারীকে খুন করতে ৩০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছিল।“

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৭ সেপ্টেম্বর সাভারে টিনশেডের ভাড়া করা এক বাসা থেকে পারুল বেগমের (৪৫) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

নিহত পারুল বেগম

টিনশেড ঘর ভাড়া নিয়ে নারী খুন

পিবিআই প্রধান বলেন, সাভারে নামাবাজার এলাকায় ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পর মধ্যবয়সী এক নারী এবং এক পুরুষ স্বামী স্ত্রী পরিচয়ে একটি ঘর আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া নেন। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত ঘুম থেকে না ওঠায় কেয়ারটেকার তাদের ডাক দেয়।

কোনো সাড়া না পেয়ে পেছনে জানালা দিয়ে দেখে বিছানায় একজন নারী মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, আর কেউ নাই। জানালার লোহার গ্রিল আলগা বলে দেখতে পান কেয়ারটেকার। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।

লাশের পাশে একটি মোবাইল ফোন ও বিল্লাল সরদার নামে এক ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি পাওয়া যায়।

বনজ কুমার জানান, মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে নারীর পরিচয় পারুল বেগম বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। স্বামী পরিত্যক্তা পারুল বেগমের বাড়ী মেহেরপুরে হলেও সাভারে ঘর ভাড়া নিয়ে নিজের তৈরি করা কাপড় ফেরি করে বিক্রি করে থাকেন। তার একটি মেয়ে রয়েছে গ্রামের বাড়িতে থাকে।

প্রাথমিক সূত্র জাতীয় পরিচয়পত্র

লাশের পাশে পাওয়া পরিচয়পত্রের বিল্লাল সরদারের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা থানার চিলা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায়।

পিবিআই প্রধান বলেন, “তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই ব্যক্তির ব্যাপারে সন্দেহ হলে তাকে অনুসরণ করি। জানতে পারি ইউপি নির্বাচনের মেম্বার পদপ্রার্থী।

“তাকে গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ না করে তার ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি কখনও ঢাকায় আসেনি।“

তিনি জানান, এরপরই পিবিআই তার সঙ্গে কথা বলে। জানতে চায় তার কোনো শত্রু আছে কি না। তখন নির্বাচনকেন্দ্রিক কয়েকজনের মধ্যে নাম জানতে পারে।

গোপনে তাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে হালিম হাওলাদার নামে একজনকে সন্দেহ করা হয় যিনি চিলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য এবং বর্তমান প্রার্থী।

হালিমকে গ্রেপ্তার না করে অনুসন্ধান

“আমরা হালিম হাওলাদারকে বুঝতে না দিয়ে গ্রেপ্তার না করে গোপনে তার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে থকি। অনুসন্ধান করে জানতে পারি ওই মেম্বারের সাথে ঢাকায় থাকা পিরোজপুরের জামাল হাওলাদার নামে একজনের বেশ যোগাযোগ।”

ভাঙ্গারী ব্যবসায়ী জামাল হাওলাদারকে বেশ কয়েকদিন গোপনে অনুসন্ধান করে ‘হঠাৎ করে তার চালচলনে’পরিবর্তন দেখা যায়। সন্দেহ হলে তাকে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সাভারের টিন শেড ঘরে নিয়ে যাওয়া হলে কেয়ারটেকার তাকে চিনতে পারে এবং ওই নারীর সঙ্গে স্বামী পরিচয় দিয়ে এই ঘর ভাড়া নিয়েছিল বলে জানায়।

মূল খুনি গ্রেপ্তারের পর হত্যার দায় স্বীকার

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সাভারের সেই ঘরে নেওয়ার পর জামাল হাওলাদার নিহত নারীকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ভাড়া নিয়েছিল বলে স্বীকার করে। এক্ষেত্রে দর্জি মাস্টার মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজ নামে তার এক সহযোগী আছে বলে তদন্ত কর্মকর্তাকে জানায়।

তাকে নিয়েই রাজধানীর দারুস সালামের এক বাসা থেকে ওই দিন রাতেই মিলন কবিরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা পুরো পরিকল্পনা এবং হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত তুলে ধরে পিবিআই এর কাছে।

হত্যার উদ্দেশ্য বিল্লাল সরদারকে ফাঁসানো

হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মোংলার চিলা ইউনিয়নের মেম্বার হালিম হাওলাদার জিজ্ঞাসাবাদে পিবিআইকে জানায়, বিল্লাল সরদার চিলা ইউনিয়নের নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী মেম্বার প্রার্থী। হালিম মনে করেছিল, তার বেশ কিছু ভোট বিল্লাল নিয়ে যাবে। তাকে দমানো দরকার। এজন্য এই প্রার্থীকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে পরিকল্পনা করে।

পরে অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিচিত জামাল হাওলাদারকে মোংলায় ডেকে নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানায় হালিম। এ জন্য ৩০ হাজার টাকার চুক্তি করে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম দেয়। এসময় বিল্লাল সরদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি জামালের হাতে তুলে দেয় হালিম। ঢাকায় এসে জামাল বিষয়টি তার বন্ধু মিলন কবিরাজের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করে এবং পরামর্শ চায়।

পরামর্শ অনুযায়ি মিলন কবিরাজ তার পরিচিত নারী পারুলকে টার্গেট করে জামালের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।

“এই মহিলাকে হত্যা করলে তার পেছনে দৌঁড়ানোর কোনো লোক নেই” জামালকে এই বলে প্রলুদ্ধ করে মিলান কবিরাজ। 

পরে পরিকল্পনা অনুযায়ী, দুই দিনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে এবং জামাল বিয়ের প্রলোভন দেখায়। সে অনুযায়ী তাকে নিয়ে সাভারের নামাবাজারে ঘর ভাড়া নেয় এবং রাতেই ওড়না দিয়ে গলা চিপে খুন করে জাতীয় পরিচয়পত্রটি রেখে পালিয়ে যায়।

বিল্লাল গ্রেপ্তার না হওয়ায় আরও খুনের পরিকল্পনা

আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, হত্যার পরও বিল্লাল গ্রেপ্তার না হওয়ায় মিলন কবিরাজ এবং জামালের মধ্যে বেশ কয়েকবার এ নিয়ে কথা হয়। এবং নতুন করে পরিকল্পনা আঁটে।

সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান বলেন, “জামাল এবং মিলন কবিরাজকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কাছ থেকে মোবাইল উদ্ধার করা হয়। জামালের মোবাইলে থাকা একটি অডিওতে শোনা যায়, ‌‘বিল্লাল যদি গ্রেপ্তার না হয় প্রথমে একজন রিক্সাওয়ালা মারব। তাতেও না হলে আরেকজন মহিলা মারব’।“

এই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এসআই সালে ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তারা প্রয়োজনে একজন হিন্দুকে খুন করে পুরো বিষয়াটি ধর্মীয়ভাবে আলোচনায় নিযে আসার পরিকল্পনাও করেছিল।

গবেষণার পরামর্শ

সংবাদ সম্মেলনে বনজ কুমার বলেন, “জামাল এবং মিলন কবিরাজের বিরুদ্ধে আগে কোনো অপরাধের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কী কারণে অল্প কিছু টাকার জন্য ভাড়াটে কিলার হবে তারা।

“তিনটি খুন করে সিরিয়াল কিলার হবে? কী এমন হল যে পাশের বাড়ির বিল্লালকে খুনের মামলায় জড়াতে হবে শুধু ইউপি নির্বাচনের জন্য? এগুলো গবেষণা দরকার।“

তিনি বলেন, “আমরা একটা ম্যাসেজ দিতে চাই এসব চাঞ্চল্যহীন এবং তদবিরবিহীন ঘটনার মামলা তদন্ত করে পিবিআই পৃকত রহস্য বের করবেই।"