অনুমোদনহীন ক্ষুদ্র ঋণ: আইনি ব্যবস্থার নির্দেশ হাই কোর্টের

দেশে যেসব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ছাড়াই ক্ষুদ্র ঋণের কারবার করছে, সেসব বন্ধের পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2021, 06:55 AM
Updated : 27 Sept 2021, 08:22 AM

সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেনের ভার্চুয়াল বেঞ্চে সোমবার রুলসহ এ আদেশ দেয়।

আদেশে বলা হয়েছে, অনুমোদনহীন ক্ষুদ্র ঋণের কারবার নিয়ে তদন্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করতে হবে। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে এ কিমিটিকে প্রতিবেদন দিতে হবে।

তদন্তের সময় যদি অননুমোদিত বা লাইসেন্স ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ কারবারী সমবায়, বা কোনো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় বন্ধের পাশাপাশি আইনি ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সুদ কারবারীদের তালিকা দিতে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এই রিট মামলার বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য ৩০ নভেম্বর তারিখ রাখা হয়েছে।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক।

সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।

গত ২৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে ‘চড়া সুদে ঋণের জালে কৃষকেরা’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে জনস্বার্থে তিনি রিট আবেদনটি করেন।

এতে মহাজনদের উচ্চহারে অনানুষ্ঠানিক ঋণ প্রথা নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি রুল চাওয়া হয়। কিন্তু আদালত সোমবার আবেদনে সংশোধন এনে রুলসহ আদেশ দেয়।

লাইসেন্স এবং অনুমোদন ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণকারবারী বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও তদারকিতে বিবাদীদের নীরবতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। 

অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান, ও সমাজসেবা অদিদপ্তরের মহাপরিচালককে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে গত সোমবার আইনজীবী সায়েদুল হক সুমন সম্পূরক আবেদনের মাধ্যমে দেশে কারা চড়া সুদের ব্যবসা করছে, কীভাবে ব্যবসা করছে, সে তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন।

মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে তিনি বলেন, ২০০৭ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭৪৬টি প্রতিষ্ঠান-সংগঠনকে ক্ষদ্রঋণের সনদ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের সনদ বাতিল করা হয়েছে।

শুনানিতে সুমন বক্তব্য ছিল, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষদ্রঋণের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ছাড়া আর করো সুদের ব্যবসা করার সুযোগ নেই। কিন্তু সারা দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দেদারসে উচ্চহারে সুদের ব্যবসা চলছে। আর এর শিকার হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এমনকি মধ্যবিত্তও।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক জানতে চেয়েছিলেন, সনদ বাতিল করার পরও কেন বিবাদীদের নিষ্ক্রীয়তা চ্যলেঞ্জ করা হয়েছে?

আইনজীবী সুমনের জবাব ছিল, সনদ বাতিল হলেও তাদের ব্যবসা থেমে নেই।

বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান তখন সনদ বাতিল করা ১৩৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোন কোন প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণের কারবার করছে জানতে চান।

আবেদনকারী আইনজীবী তা দেখাতে ব্যর্থ হলেও তিনি বলেন, মাইক্রোক্রেডিট অথরিটি চাইলে সুদের কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে এ অথরিটির কাছে অন্য কেউ অভিযোগ করতে পারবে না। অভিযোগ করতে হবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কর্তৃক্ষকে।

“এইসব কারণেই কিন্তু প্রতারক চক্র গড়ে উঠছে। মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে। তদারককারী হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারা তো তদারক করছে না। এই জন্যে তাদের নিষ্ক্রীয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে রিটে,” বলেন সুমন।

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক তখন বলেন, “এই যে এত দুর্বল দেশ, এই দর্বল দিক দিয়ে আমরা সরকারকে কী দেব, কী বলব? রাগীব (এহসান গ্রুপের চেয়ারম্যান রাগীব এহসান) নামের এক হুজুর আগে শিক্ষক ছিল। শিক্ষকতার টাকা দিয়ে হচ্ছে না। তখন ইসলামের দোহাই দিয়ে সুদমুক্ত হালাল টাকা, গুনাহ-পাপ এই সমস্ত কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে।”

আইনজীবী সুমন বিচারকের কথায় সায় দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। এরা মানুষকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষ পথে বসে যাচ্ছে।

বিচারক তখন বলেন, “এই ইস্যুটা আমাদের আরও গভীরভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। আমরা শুনেছি, বিষয়টা আমরা দেখব। একটা-দুইটা পত্রিকার রিপোর্ট দিয়ে হবে না। আরও অনেক কিছু দেখতে হবে। এটা খুবই জটিল বিষয়। এর সাথে কোন অথটিরিট জড়িত, কী কী আইন আছে, সব দেখতে হবে।”