হলুদ ট্রাঙ্ক, তরুণীর লাশ, একটি জিডি ও ৬ বছর পর খুনি গ্রেপ্তার

স্ত্রীকে হত্যার পর ট্রাঙ্কে ভরে লাশ তুলে দিয়েছিলেন ঢাকাগামী একটি বাসে। পরের দুই দিন এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর না হওয়ায় হত্যাকারী ভেবেছিলেন, ‘এ নিয়ে আর ঝামেলা হবে না’।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Sept 2021, 02:42 PM
Updated : 25 Sept 2021, 02:45 PM

পরে সাড়ে চার বছরের তদন্তে সেই লাশের আর পরিচয় জানতে পারেনি পুলিশও। তবে শেষ রক্ষা হয়নি।

পুলিশি তদন্তের সাড়ে চার বছর পর আদালত চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ না করে মামলা পুনরায় তদন্ত করতে নির্দেশ দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন- পিবিআইকে। এ ইউনিটের দেড় বছর তদন্তের পর একটি জিডির সূত্র ধরে জানা গেল তরুণীর পরিচয়, গ্রেপ্তার হল খুনী।

শনিবার পিবিআই সদর দপ্তরে আয়েজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনের বিস্তারিত তুলে ধরে পুলিশের বিশেষায়িত এ ইউনিটের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “কাজটা বেশ দূরহ ছিল।

তিনি জানান, প্রায় ছয় বছর আগে গাবতলীতে ট্রাঙ্ক থেকে উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাতনামা এক তরুণীর লাশ ও তার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করা হয়।

শম্পা নামের ওই নারীর পরিচয় বের করার পাশাপাশি গত বৃহস্পতিবার হত্যার অভিযোগে করপোরাল পদ মর্যাদার নৌ বাহিনীর সাবেক মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট রেজাউল করিম স্বপনকে গ্রেপ্তারের কথা জানান পিবিআই প্রধান।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিআইডি চার বছর সূত্রবিহীন (ক্লুলেস) এ হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছিল।

লাশ মেলে যেভাবে

বনজ কুমার মজুমদার জানান, ২০১৫ সালের ৩ মে সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম এ কে খান মোড়ে ঈগল পরিবহনের কাউন্টারে টিকেট কেটে এক ব্যক্তি ঢাকামুখী বাসে একটি ট্রাঙ্ক তুলে দেন। তিনি বাসের হেলপারকে বলেন, পরবর্তী ভাটিয়ারি কাউন্টার থেকে এক মহিলা উঠবেন তাকে যেন তুলে নেওয়া হয়।

কিন্তু ওই কাউন্টারে কাউকে না পেয়ে বাসটি ছেড়ে দেয়। বিকাল পৌনে ছয়টার দিকে গাবতলীতে পৌঁছার পর সব যাত্রী তাদের মালামালসহ নেমে যায়। শুধু পড়ে থাকে ট্রাঙ্কটি। তখন সেটি নামাতে গিয়ে অস্বাভাবিক ভারি মনে হওয়ায় হেলপার ও চালক পুলিশকে খবর দেয় বলে পিবিআই প্রধান জানান।

থানা পুলিশ ক্লু পায়নি তিন মাসে

দারুস সালাম থানা পুলিশ হলুদ রংয়ের ট্রাঙ্কটি খুলে এক তরুণীর মৃতদেহ পায়। হত্যা মামলা দায়েরের পর থানা থেকে অজ্ঞাত ওই তরুণীর পরিচয় শনাক্তসহ হত্যার ঘটনা উদঘাটনের চেষ্টা চলে। তিন মাসে তদন্তের কিনারা না হলে দায়িত্ব নেয় সিআাইডি।

সিআইডির চার বছর

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার জানান, সিআইডি ক্লু লেস এ হত্যার তদন্তে নেমে কোনো কূল কিনারা করতে পারেনি।

তিনি বলেন, "তারা লাশের পরিচয় এবং হত্যার রহস্য উন্মোচন করতে না পেরে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

“কিন্তু আদালত তা গ্রহণ না করে অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দেয়।“

দেড় বছরে রহস্যভেদ

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পিবিআই তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই বাসের চালক, হেলপারসহ সবার সঙ্গে কথা বলে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় নিখোঁজ জিডির অনুসন্ধানে নামে। ট্রাঙ্কের ও নিহত নারীর ছবি দিয়ে পোস্টার তৈরি করে।

এরপর বাসের যে কাউন্টার থেকে ট্রাঙ্ক তোলা হয়েছিল সেই পাহাড়তলী থানা এলাকা ও ইপিজেডসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে পরিচয় জানার চেষ্টা করা হয়।

মামলার সূত্র মেলে পাহাড়তলী থানার জিডিতে

টানা এক সপ্তাহ ধরে থানার পুরনো ফাইল ঘেঁটে ২০১৫ সালের ১০ জুনের একটি নিখোঁজ জিডিতে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তার চোখ আটকে যায়। বিজিবি এর সদস্য ল্যান্স নায়েক আব্দুল মান্নান শেখের করা এই জিডি আশার আলো দেখায় বলে জানান পিবিআই প্রধান।

ওই ব্যক্তি জিডিতে উল্লেখ করেছেন, তার স্ত্রীর ছোট বোন শম্পা বেগম নিখোঁজ হয়েছেন। কিন্তু জিডিতে মান্নান শেখের আর কোনো তথ্য না থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে শম্পার ঠিকানা ও পরিচয় থাকায় তার বাবা ইলিয়াস শেখের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়, যোগ করেন বনজ কুমার।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, "জিডির ঠিকানার সূত্র ধরে খুলনার দৌলতপুরে বসবাসকারী শম্পার বাবার সঙ্গে কথা বলি। তিনি প্রথমেই প্রশ্ন রাখেন- আপনারা কি হলুদ ট্রাঙ্ক পেয়েছেন?

“ইলিয়াস শেখ সেনাবাহিনীতে সিভিল স্টাফ ছিলেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। হলুদ ট্রাঙ্কের কথা শুনে তিনি তার মেয়ে শম্পার নিখোঁজ হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।“

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ইলিয়াস শেখ তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন শম্পা ও তার স্বামী, নৌবাহিনীর করপোরাল পদমর্যাদার মেডিকেল অ্যাসিসটেন্ট রেজাউল করিম স্বপন তখন চট্টগ্রামে থাকতেন।

২০১৫ সালের ৩ মে মেয়েকে ফোনে না পেয়ে জামাই স্বপনকে ফোন করেন তিনি। স্বপন জানায়, শম্পা জরুরি কাজে খুলনা রওনা হয়েছে কাল পৌঁছে যাবে। কিন্তু আর মেয়ে আর আসেনি।

পরে অনেক খোঁজাখুজি করে না পেয়ে প্রায় এক মাস পর পাহাড়তলী থানায় জিডি করেন শম্পার ভগ্নিপতি।

স্বপনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও গ্রেপ্তার

বনজ কুমার জানান, মেয়ের খোঁজ না পেয়ে ২০১৫ সালে স্বপনের বিরুদ্ধে নৌবাহিনীতে লিখিত অভিযোগ দেন ইলিয়াস শেখ। কিন্তু বিভাগীয় তদন্তে কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় চাকরিতে বহাল থাকেন। পরে ২০১৯ সালে আবারও অভিযোগ দেওয়া হলে নৌবাহিনী কর্তৃপক্ষ তাকে অবসরে পাঠিয়ে দেয়।

ইলিয়াস শেখের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে স্বপনকে খুঁজে পেতে তার কুমিল্লার স্থায়ী ঠিকানা নৌবাহিনী থেকে নেওয়া হয়। কিন্তু ওই ঠিকানায় তাকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায় স্বপন একটি একটি ফার্মেসিতে বসেন। সেখানেও তাকে না পেয়ে বৃহস্পতিবার কুমিল্লার অপর এক জায়গা থেকে কৌশলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান পিবিআই প্রধান।

হত্যার দায় স্বীকার

গ্রেপ্তারের পরপরই হত্যার দায় স্বীকার করে স্বপন পিবিআইকে জানায়, বিএনএস তিতুমীর খুলনায় কর্মরত অবস্থায় শম্পার মা চিকিৎসার জন্য খুলনায় আসলে তখন শম্পার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। কিছুদিন পরে স্বপন চট্টগ্রামে বদলি হলে সেখানে শম্পা যায় এবং তারা বিয়ে করেছে বলে শম্পাকে দিয়ে তার পরিবারকে জানায়।

স্বপন জানায়, চট্টগ্রামে প্রথমে তারা একটি হোটেলে থাকে। পরে পাহাড়তলীতে অবসরপ্রাপ্ত এক সৈনিকের বাড়ি ভাড়া নেয়। সেখানে ২০১৫ সালের ৩ জুন সকালে বিয়ে নিয়ে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে ওড়না দিয়ে গলায় পেঁচিয়ে শম্পাকে হত্যা করে।

হত্যার ঘটনা আড়াল করতে কৌশল নেয় স্বপন। লাশটি শম্পার বাড়ি থেকে আনা ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রিক্সায় করে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে ঢাকাগামী বাসে তুলে দেয়।

বাসে ওঠানোর সময় ভারি মনে হওয়ায় রিক্সাওয়ালা প্রশ্ন করলে সে জানিয়েছিল, ভেতরে কাঁচের জিনিস আছে।

গ্রেপ্তারের পর স্বপন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

দুই দিন টিভি পত্রিকা মনিটর করে স্বপন

গাড়িতে তুলে দেওয়ার পর দুইদিন টিভি- পত্রিকা মনিটর করে স্বপন। কিন্তু কোথাও সেভাবে কোনো সংবাদ না আসায় সে নিশ্চিত হয়, এটা নিয়ে আর কোনো ঝামেলা হবে না।

"স্বপন আমাদের বলেছে নিউজ হলে সে অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিত," যোগ করেন পিবিআই প্রধান।

তবে শেষ রক্ষা আর হয়নি।

আরও পড়ুন