নদীর দখল ঠেকানো ও নাব্যতা রক্ষার লড়াই

দেশে সাড়ে সাতশরও বেশি নদীর ৬০ হাজার দখলদার চিহ্নিত করে প্রায় ১৮ হাজারকে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদককামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2021, 07:09 AM
Updated : 26 Sept 2021, 07:43 AM

তবে বর্তমানে কয়টি নদীতে স্বাভাবিক প্রবাহ আছে? কয়টি নদী হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা হারিয়ে গেছে? তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কমিশন জানিয়েছে- একটি তালিকা তৈরির চেষ্টা চলছে।

পরিবেশ কর্মীরা বলছেন, নদী রক্ষায় সরকার এখনই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শুরু না করলে ইউরোপের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়তে বেশি বাকি নেই।

১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার ‘বিশ্ব নদী দিবস’ পালন করে আসছে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া (বিসি) ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। সে হিসাবে এ বছর বিশ্ব নদী দিবস ২৬ সেপ্টেম্বর।

বর্ষা পার হল কেবল, তাই বুড়িগঙ্গার জল স্বচ্ছ বলে মাছও মিলছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

‘বিশ্ব নদী দিবস’ ঘিরে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এএসএম আলী কবীরের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে আশা জাগানোর মতো কিছু আছে কি না?

উত্তরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, যেসব নদী রয়েছে, সেগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং দখলমুক্ত করার জন্য কাজ করছে কমিশন। এজন্য বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং দেওয়া হচ্ছে।

দেশে প্রায় ৭৭০টির মতো নদীর নাম পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কমিশনের প্রধান কাজ হচ্ছে নদীকে দখলদারমুক্ত করা এবং নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।”

নদ-নদীগুলোকে আগের চেহারায় ফেরানো যাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কাজ করে যাচ্ছি। এই পর্যন্ত  ৬০ হাজার দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রায় ১৮ হাজার ‌দখলদারের হাত থেকে নদীর প্রবাহ উদ্ধার করা হয়েছে।

“বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলে নদনদীর স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।”

বর্ষা বাদে বছরের বাকিটা সময় বুড়িগঙ্গার জল থাকে এমন দূষিত। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

 

২০২০ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ না করলেও ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে নদীর দখল ও দূষণের চিত্র ফুটে উঠেছে।

এতে বলা হয়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের সকল বিভাগ, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলাশয়, জলাধার সরেজমিন পরিদর্শন করেছে।

ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, আদি বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর বাস্তব অবস্থা একাধিকবার সরেজমিন পরিদর্শন করেছে কমিশন।

নদী ও জলাশয়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদে তুরাগ তীরের কামারপাড়া অংশে বিআইডব্লিউটিএর অভিযান। ফাইল ছবি

এসময় স্থানীয় জনসাধারণ, পরিবেশবাদী সংগঠনের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, সুশীলসমাজসহ সর্বস্তরের জনগণ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদী দূষণরোধে জোর দাবি জানিয়েছেন।

ঢাকার কামরাঙ্গীচর সংলগ্ন চ্যানেলের (আদি বুড়িগঙ্গার ২য় চ্যানেল) অধিকাংশ জমি অবৈধভবে দখল করা হয়েছে এবং কয়েক হাজার স্থাপনা ও বাড়িঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

কামরাঙ্গীচর ও নবারের চর বুড়িগঙ্গা নদীকে বিভক্ত করে ফেলেছে। ফলে আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলটিতে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে চ্যানেলটির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে।

কী পরিমাণ বর্জ্য চট্টগ্রাম কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে, তা পলিথিনের এই স্তূপ দেখলেই বোঝা যায়। ছবি: সুমন বাবু

নদীর জায়গায় ‘ম্যাটাডোর পার্ক এবং ‘পান্না’ গ্রুপের কারখানা স্থাপনা করা হয়েছে। এমনকি নদীর জায়গায় হাসপাতালও রয়েছে। এছাড়া নদীর জমির উপর নির্মাণ করা হয়েছে ‘সুগন্ধা কৃষি মার্কেট’।

ঝাউচরের আশেপাশের এলাকায় নদীর তীরে স্থায়ী স্থাপনা রয়েছে এবং নদীর সীমানার মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বৈদ্যুতিক টাওয়ারও রয়েছে।

বুড়িগঙ্গার নদীর মতোই সারাদেশের নদনদীতে দখলদারদের রাজত্ব চলছে মন্তব্য করে পরিবেশ গবেষক আবু নাসের বলেন, “সরকার নদনদী রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়, কিন্তু শেষের দিকে এসে ওই উদ্যোগগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে।

“সারা বিশ্বে জলবায়ুর পরিবর্তন যেভাবে হচ্ছে, আমাদের উদ্যোগগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন না করলে ইউরোপের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে।”

পাশে বালু নদী, দুপাশে সবুজ গাছের সারি- এমনটা ঢাকা শহরে পাওয়া মুশকিল। তাই অনেকে কিছু সময়ের জন্য ঘুরতে যান বেরাইদ গ্রামে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

তিনি বলেন, “কিছু দিন আগে আমরা কী দেখেছি? অতি বৃষ্টির কারণে ইউরোপের শহরগুলোর কি হাল হয়েছে? সরকারকে বলব আর সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। যেসব নদী আছে, তা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

হারিয়ে যাওয়া নদনদীর সংখ্যা এবং সেসব উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যে কয়টা নদী আছে, এগুলো সরকার দখলমুক্ত ও শোষণমুক্ত করুক।”

নদীর তীর ঘেঁষে থাকা বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী এর আগে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, “এর মানে এই নয় যে, ওই প্রতিষ্ঠান ওখানে থাকবে।

“যেহেতু বড় প্রতিষ্ঠান, অনেকে খাদ্য পণ্যও উৎপাদন করে। তাই আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর যেন কোনো প্রভাব না পড়ে সেজন্য সময় দেওয়া হয়েছে। ওইসব প্রতিষ্ঠান সরাতেই হবে।”

নরসিংদীর মেঘনা বাজার এলাকায় মেঘনা নদীর ভেতরে মাছ শিকারের জন্য বাঁশের বেড়া দিয়ে কচুরিপনা আটকে রেখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এটাও এক রকম নদী দখল। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

তিনি বলেন, মানুষ একটা সময় মনে করতো নদী ‘তাদের’। নদনদীর আবার মালিক কী?

আগের সরকারগুলোর প্রতি ‘উদাসিনতার’ দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “তখন হরহামেশা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। কিন্তু এখন মানুষ ভাবতে শিখেছে যে, নদীর তীরে কিছু স্থাপন করা যাবে না এবং নদীর মালিক হচ্ছে সরকার।

বর্তমান সরকার এই ভাবনা জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “সময় দেওয়া হয়েছে, নদীর তীরে যত বড় প্রতিষ্ঠানই থাকুক না কেন, সব প্রতিষ্ঠানকে সরতে হবেই।”