ইয়াবার পথেই আসছে আইস

ইয়াবার মতই মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পথে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে ‘মেথামফিটামিন’ মাদক ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’; আর এ কাজেও রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ভাষ্য।

লিটন হায়দারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2021, 04:33 PM
Updated : 24 Sept 2021, 04:34 PM

অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান বলছেন, ইয়াবা এবং আইস- দুই মাদকেরই মূল উপাদান মেথামফিটামিন। তবে ইয়াবার চেয়ে আইস ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি শক্তিশালী মাদক, দামও অনেক বেশি। 

ফলে বেশি লাভের আশায় মাদক কারবারিরা এখন আইসের ব্যবসায় ঝুঁকছে। আর দাম বেশি হওয়ায় শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণরাই এ মাদকে আসক্ত হচ্ছে।

বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ঢাকার কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে  ৫৬০ গ্রাম ‘আইস’ এবং ১২০০ ইয়াবা।

শুক্রবার অধিদপ্তরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ে (উত্তর) এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রথম আইস ধরা পড়েছিল ২০০৭ সালে। তারপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০১৯ সালে আবার এ মাদক আসতে শুরু করে বাংলাদেশে। তার পর থেকেই এর প্রসার ঘটেছে।

“ইয়াবা যেভাবে আসে আইস সেভাবেই আসে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আসে। গভীর সমুদ্রে হাতবদল হয়। ইয়াবা ব্যবসার যারা হোতা, তারা এই আইস ব্যবসাটাকে ছড়িয়ে দেওযার চেষ্টা করছে।”

বাংলাদেশে শুরুর দিকে মাদক হিসেবে আফিম ও গাঁজাই চলত। গত শতকের আশির দশকে সেগুলো নিষিদ্ধ করা হয়। ওই সময়ে কোডিন মিশ্রিত কফ সিরাপ নিষিদ্ধ হওয়ার পর চোরাই পথে আসা ফেনসিডিল হয়ে ওঠে মাদকসেবীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়।

প্রায় দুই দশক হলো ফেনসিডিলের জায়গা দখল করেছে ইয়াবা। ফেনসিডিল মূলত আসত ভারত থেকে, আর ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে।

২০১৮ সালে মূলত ইয়াবা ঠেকানোর লক্ষ্য নিয়েই মাদকের বিরুদ্ধে বড় অভিযানে নেমেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে কয়েকশ সন্দেহভাজন।

বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ওই ঘটনায় র‌্যাব-পুলিশকে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হলেও সেই অভিযানেও ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়নি। প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা ধরার খবর আসছে। সেই সঙ্গে এখন উদ্ধার হচ্ছে ‘এলএসডি’, ‘আইসের’ মতো মাদক নিয়ে, যেগুলো আগে এ দেশে কম প্রচলিত ছিল। 

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আইস অত্যন্ত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নেশা সৃষ্টিকারী মাদক। নেওয়ার পর মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে। হিংস্র আচরণ করেন সেবনকারী। অতিরিক্ত সেবনকারী আত্মহত্যা করতে পারে। অন্য কাউকে হত্যা করতেও দ্বিধাবোধ করে না।

এই মাদক সেবনকারীর কিডনি নিস্ক্রয় হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়, কোষ্টকাঠিন্যসহ নানা ধরনের জটিলতা হয় বলেও জানান ফজলুর রহমান।

“ইয়াবা এবং আইসের উপাদান এক হলেও ইয়াবার চেয়ে আইস ২০ থেকে ২৫ গুণ বেশি শক্তিশালী। ফলে সেবনকারীর ক্ষতি খুব দ্রুত হয়।”

যেভাবে ধরা হল ৫ জনকে

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছর ৯ অগাস্ট আইসসহ একজনকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২০ এবং ২১ অগাস্ট অভিযান চালিয়ে ১০ জনের একটি ‘সিন্ডিকেট’ অধিদপ্তরের জালে ধরা পড়ে। ‘উল্লেখযোগ্য পরিমাণ’ আইসও উদ্ধার করা হয়।

এই ১০ জনের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে  এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বুধ ও বৃহস্পতিবার গুলশান, ভাটারা, কুড়িল এবং রমনা এলাকা থেকে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এরা হলেন- জাকারিয়া আহমেদ অমন (৩২), তারেক আহমেদ (৫৫), সাদ্দাম হোসেন (৩১), শহীদুল ইসলাম খান (৪৮) ও জসিম উদ্দিন (৫০)।

ফজলুর রহমান বলেন, প্রথমে বুধবার রাতে জাকারিয়া অমন এবং তারেককে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা বেশ কিছু তথ্য দেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পরের রাতেই অভিযান চালিয়ে সাদ্দাম, শহীদুল ও জসিমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

বুধবার ও বৃহস্পতিবার রাজধানীতে ৫৬০ গ্রাম আইস এবং ইয়াবাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর

গ্রেপ্তাররা উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত, ব্যবসায়ী

সংবাদ সম্মেলনে ফজলুর রহমান বলেন, “দামি এবং ভয়ঙ্কর মাদক ‘আইস’ সকলের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। প্রতি গ্রাম ৯ খেকে ১০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। যার কারণে উচ্চবিত্ত, স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছাড়া ব্যবহার করতে পারে না।”

তিনি জানান, অষ্ট্রেলিয়ায় বিবিএ সম্পন্ন করা জাকারিয়া আহমেদের বাবা একজন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। তার দুই বোন বিদেশে থাকে। তাদের ‘প্রচুর’ টাকা পয়সা আছে।

গ্রেপ্তার তারেক আহমেদ সম্পর্কে অতিরিক্ত পরিচালক জানান, তারেক ইংল্যান্ড থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেছে। তার বাবা সরকারি চাকরি করতেন, তিনি মারা গেছেন।

“তার নিজের বাড়ি আছে বারিধারায়, অনেক বড় বাসা। বেশ অবস্থাসম্পন্ন,” বলেন তিনি।

সাদ্দাম হোসেন বাবার সঙ্গে সিএন্ডএফ ব্যবসা করেন জানিয়ে অধিপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, “সাদ্দাম বাবার থেকে পাওয়া অর্থ ছাড়াও নিজের ব্যবসা থেকে ভাল আয় করেন। ফলে তার এসব মাদক কেনায় খুব সমস্যা হয় না।”

একজন ব্যবসায়ীর ছেলে শহীদুল ইসলাম খান পেশায় গাড়ি চালক জানিয়ে ফজলুর রহমান বলেন, “তিনি বেছে বেছে ট্রিপ নেন। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা তার মূল টার্গেট। এসব যাত্রীদের কাছ থেকে তিনি ভাল আয় করেন।

“তার সাথে এক হোটেল ব্যবসায়ীর পরিচয় হয়। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা। তার মাধ্যমে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এরপরেই ওই হোটেল ব্যবসায়ীর লোভনীয় অফারে আইস ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েন শহীদুল।”

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা জানান, জসিম উদ্দিনের দুটি ছয়তলা বাড়ি আছে। তার নিজস্ব একটা রেস্তোরাঁও আছে। উচ্চবিত্ত এবং স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান জসিম ‘লোভে পড়ে’ এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

গ্রেপ্তারের পর জসিম উদ্দিন বলেন, রেস্তোরাঁয় আসা একজনের সঙ্গে পরিচয় থেকে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই লোকই অল্প টাকায় বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে ‘আইসের’ ব্যবসায় তাকে প্রলুদ্ধ করেন।

 “একটা মাদকের চালান নিয়ে এলে একটা গাড়ির মালিক হওয়া যায়- এভাবেই জসিম উদ্দিনকে প্রলুদ্ধ করা হয়েছিল। এর পরেই জসিম এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন,” বলেন ফজলুর রহমান।

‘গড ফাদারদের ধরা যাচ্ছে না’

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক বলেন, দুই-তিন মাস আগে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা হাল নাগাদ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকাতেই প্রায় সাড়ে তিন হাজার ‘মাদক ব্যবসায়ী’ রয়েছে।

“সেই তালিকা ধরে ধরে টার্গেট করেছি। সেই হিসাবে তাদের পেছনে ছুটছি। গোয়েন্দা সোর্স লাগিয়েছি। নিজেদের লোকজন কাজ করছে, পেশাদার সোর্স কাজ করছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।”

মাদকের ‘গড ফাদারদের’ ধরতে নানা ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হলেও তাদের নেতৃত্ব বদলে যায় বলে ব্যবসাও টিকে থাকে বলে মন্তব্য করেন ফজলুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘গড ফাদার’ এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের তালিকা আলাদাভাবে আছে। পেশাদার সোর্সের দেওয়া তথ্য, নিজস্ব পদ্ধতিতে সংগ্রহ করা তথ্য, সমাজের গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য, জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমামসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য মিলিয়ে ওই তালিকা তৈরি করা হয়েছে।

ওই তালিকায় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষ আছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান ফজলুর রহমান।

“মাদক ব্যবসায়ীদের নিচের লেভেলে যারা কাজ করে তারা এত বেশি শক্ত, এমনভাবে তাদের প্রশিক্ষিত করা হয় যে তারা তাদের যে মূল হোতা বা তাদের যে গড ফাদারদের নাম সহজে বলতে চান না।”

মাদক আইনে সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে ফজলুর রহমান বলেন, “মাদকদ্রব্য কারো সঙ্গে না পাওয়া গেলে তাকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তারপরও চেষ্টা আছে। এবং কিছু ক্ষেত্রে সফলতাও আছে।

“আমরা চেষ্টা করি গডফাদারদের গ্রেপ্তারের জন্য। কিন্তু তারা নিজেদের পজেশনে মাদক রাখার বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। তারা দূরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন কিংবা অর্থ বিনিয়োগ করেন, পৃষ্ঠপোষকতা দেন।”

তবে অধিদপ্তরের জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় আগামীতে এ কাজে আরও সাফল্য পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী ফজলুর রহমান।

তিনি বলেন, “মাদক ব্যবসায়ীদের ধরার জন্য কৌশল পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই কৌশলের সফলতা দেখতে পাচ্ছি।”