নতুন শিক্ষাক্রম: পরীক্ষা কমানো ‘ভালো’, বাস্তবায়নই ‘চ্যালেঞ্জ’

দেশের মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রায় আমূল বদলে ফেলতে নতুন যে শিক্ষাক্রম তৈরি করেছে সরকার, তাতে অনেকগুলো ইতিবাচক দিক দেখলেও বাস্তবায়নকেই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Sept 2021, 05:33 PM
Updated : 22 Sept 2021, 05:43 PM

বড় এই পরিবর্তনের জন্য দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

গত ১৩ সেপ্টেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সাংবাদিকদের সামনে নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা তুলে ধরেন।

তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখা, এসএসসি’র আগে কোনো পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের বিভাজন তুলে দেওয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন রাখা হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে।

এছাড়া পরীক্ষার চাপ কমাতে বছর শেষে সামষ্টিক মূল্যায়নের আগে শিক্ষাবর্ষ জুড়ে চলবে শিখনফল মূল্যায়ন।

আগামী বছরই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তিত শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হবে।

২০২৩ সাল থেকে এটি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। আর ২০২৫ সাল থেকে পুরোপুরি নতুন শিক্ষাক্রমে পড়বে শিক্ষার্থীরা।

একে পরীক্ষা, বিষয়বস্তু ও পাঠ্যপুস্তকের চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বের করে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শেখার মাধ্যমে পাঠচক্রকে ‘আনন্দময় করার উদ্যোগ’ বলছে সরকার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও বাস্তবভিত্তিক করতে এই পরিবর্তনগুলো প্রত্যাশিত ছিল। তবে বড় পরিবর্তনে যাওয়ার আগে আরও পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল।

নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি অবধি কোনো পরীক্ষা থাকবে না। ফাইল ছবি

পরীক্ষা কমানো কি ভালো হল?

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কমিয়ে আনাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তার মতে, এতে শিক্ষার্থীদের চাপ কমার পাশাপাশি সরকারি ব্যয় ও অভিভাবকদের খরচ কমবে।

“এই পরীক্ষার বাহুল্য যত কমানো যায়, আমি তার পক্ষপাতি। এখন পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা আমার কাছে সঠিক মনে হচ্ছে। কেননা পাবলিক পরীক্ষার নাম দিয়ে শিশুদের পরীক্ষামনস্ক করে তোলা, গাইডবই-কোচিংয়ের দিকে ঝোঁকা, এটা অন্যায্য কাজ।“

ঢাকার নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ হেমন্ত পিউস রোজারিও বলছেন, পরীক্ষা কমিয়ে আনায় শিশুরা এখন আনন্দ নিয়ে পড়বে।

“কারণ পিইসি, জেএসসি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় অনেক ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। কোচিং বাণিজ্য বেড়ে গেছে। ছোট ছোট বয়সে বড় পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। এগুলো না হলে অনেক সময় বেঁচে যাবে। ক্লাসে সেই সময়টা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।”

মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, “তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত যে পরীক্ষা হবে না- এটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত।

“এই ছোট ছোট বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড- এসব অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হয়। এখন এটা থাকবে না, কিন্তু একটা মূল্যায়ন ঠিকই হয়ে যাবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মরিয়ম বেগম তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পরীক্ষা না রাখাকে ‘ভালো’ বললেও অষ্টম শ্রেণিতে একটি পাবলিক পরীক্ষা রাখার পক্ষে মত দেন।

তিনি বলেন, “কারণ গ্রামের অনেক শিক্ষার্থী অষ্টম শ্রেণির পরে আর পড়তে পারে না। তখন অষ্টম শ্রেণীর সার্টিফিকেট দিয়ে কোনো কাজে ঢুকতে পারত।”

নতুন শিক্ষাক্রমে তবে নবম-দশম শ্রেণিতে আগের মতো বিভাজন থাকবে না, একই পাঠ্যসূচি থাকবে সবার জন্য। ফাইল ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

নবম-দশম বিভাজন না থাকা কতটা ঠিক?

দীর্ঘদিন ধরে নবম শ্রেণিতে গিয়ে বিজ্ঞান, মানবিক আর বাণিজ্য ধারায় আলাদা হয়ে যেত শিক্ষার্থীরা।

নতুন শিক্ষাক্রমে তাতে পরিবর্তন আসার বিষয়ে নটরডেমের অধ্যক্ষ হেমন্ত পিউস রোজারিও বলেন, “অনেক দেশেই এটা আছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সিলেবাস কীভাবে প্রস্তুত করবে, সেটা একটা বিষয়।

“এইচএসসিতে এখন দেড় বছরের মতো সময় পাওয়া যায়। এই একই সময় যদি থাকে, সেটা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য কম হয়ে যাবে। সায়েন্সের ব্যাকগ্রাউন্ড যদি যথেষ্ট শক্ত না হয়, তাহলে পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিকের দেড় বছরে সেটা কঠিন হয়ে যাবে।”

এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সব দেশেই উচ্চ মাধ্যমিক চার বছরে হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা দেড় বছর। এটা যথেষ্ট সময় না। এই দিকটিতে নজর দেওয়ার প্রয়োজন।”

একই বিষয়ে জোর দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মরিয়ম বেগম বলেন, “বলা হচ্ছে, যে বিষয়টি উচ্চ শিক্ষার সময় পড়বে, সেটাই সে উচ্চ মাধ্যমিকে নিবে।

“কিন্তু আগের শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে এবং উচ্চ মাধ্যমিক থেকে উচ্চ শিক্ষায় একটা গ্যাপ ছিল। এখন মনে হচ্ছে, এই গ্যাপটা আরও বেড়ে যেতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, শুধু উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে তারা যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য যাবে, তখন তাদের মধ্যে ঘাটতি থেকে যাবে।”

ব্যাখ্যা দিয়ে  তিনি বলেন, “নবম-দশম শ্রেণিতে যদি অনেক বিষয় থাকত, সেখান থেকে তারা পছন্দের বিষয়টি নিয়ে পড়তে পারত। ধরা যাক- ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য গণিত, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে তার সাথে সে চাইলে অর্থনীতি পড়তে পারত। যেটা বিদেশে হয়ে থাকে। সেরকম করলে ভালো হত, না হলে গ্যাপটা বোধহয় থেকে যাবে। শিক্ষার্থীরা একটা ধাক্কা খাবে (উচ্চ শিক্ষায় গিয়ে)।”

তবে নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাজন না থাকায় শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমবে বলে মনে করেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম।

তিনি বলেন, “আমরা ছেলেমেয়েদের চাপিয়ে দিই- তোমাকে সায়েন্স পড়তেই হবে, ডাক্তার হতেই হবে। সায়েন্স না পড়লে প্রেস্টিজিয়াস ইস্যু হয়ে যায়। এগুলো করতে করতে বাস্তব জ্ঞানটুকু ছেলেমেয়েদের কমে যাচ্ছে। সামাজিকতা, ভৌগোলিক জ্ঞান কমে যাচ্ছে।

“দেখা যায়, এসএসসিতে রেজাল্ট ভালো করতে না পেরে সে কমার্সে চলে যায়। কমার্স থেকে আর্টসে যায়। এখন নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার পর শিক্ষার্থী নিজেই নিজের মূল্যায়ন করতে পারবে। নিজেই বুঝবে কোন দিকে যাবে।”

নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের নতুন পদ্ধতিতে মূল্যায়নে শিক্ষকরা কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। ফাইল ছবি: মাহমুদ জামান অভি

পরিবর্তনটা কেন?

শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন ‘আমলাতান্ত্রিকভাবে’ না করে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে করা দরকার ছিল বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

তার প্রশ্ন, শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের প্রয়োজন হল কেন, তা আগে সরকারের বোঝানো দরকার।

“কেন প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষা হবে, কেন আবার ক্লাস এইটে পরীক্ষা হবে- এসব কেন করা হয়েছিল, সেটা আমরা বুঝি নাই। আবার এখন কেন পরীক্ষা কমিয়ে নেওয়া হল- সেটার ব্যাখ্যাও দেওয়া হল না।

“শিক্ষাটা তো পাবলিকের, তাহলে তারা কেন জানবে না? কেন অতিরিক্ত পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল, কেন আবার অতিরিক্ত পরীক্ষা বাদ দেওয়া হল।”

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “তাহলে কি আগের পরীক্ষা নীতিটা ভুল ছিল? পরীক্ষা নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমি মনে করি সঠিক নয়।”

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা নয়, গুরুত্ব থাকবে ক্লাসে শেখার উপর।ফাইল ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

চ্যালেঞ্জটা কোথায়?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মরিয়ম বেগমের মতে, শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এই পরিবর্তন প্রয়োগ করাই আসল কথা।

এটার বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে তিনি বলেন, “একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- আমরা শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষকরা কতটা প্রস্তুত- সেটা ভাবতে হবে।

“মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আসছে। সেটার জন্য আমাদের স্কুল ও শিক্ষকরা কতটুকু প্রস্তুত, সেটাও একটা বিষয়। পরিবর্তন আসা দরকার, সেটা ঠিক। কিন্তু সেই পরিবর্তন কতখানি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারব?”

দেড় যুগ ধরে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলে আসা শাহান আরা এক যুগ আগে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর তাতে সফলতা না আসার কথা বলেন।

“এক যুগ ধরে যে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে, তা শিক্ষার্থীদের কোনো উপকারে আসছে না। গ্রামাঞ্চলের অনেক শিক্ষক এখনও সৃজনশীল বোঝেই না।”

অধ্যাপক মরিয়ম বলেন, “আগের কারিকুলামই আমরা এত বছর ধরে বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আর এখন একটা বিশাল পরিবর্তন এনে যদি ভেবে নিই এটা খুব সহজেই বাস্তবায়ন করতে পারব- সেটা বাস্তবসম্মত হবে না।

“কারণ টিচিং ও লার্নিংয়ের যে পদ্ধতিগুলো এখানে চিন্তা করা হয়েছে, সেটি বিশাল পরিবর্তনের বিষয়।”

একেবারে এত পরিবর্তনে না গিয়ে ধাপে ধাপে এগোলে তাতে মানিয়ে নিতে সুবিধা হত বলে মনে করেন এই অধ্যাপক।