ফোনে আড়িপাতা রোধে রিটের আদেশ পেছাল

আড়ি পাতা প্রতিরোধ ও ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনায় কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশনা চাওয়ার রিট আবেদনের আদেশ আবার পিছিয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2021, 10:55 AM
Updated : 19 Sept 2021, 10:55 AM

রিটের এখতিয়ার প্রশ্নে রোববার আবেদনকারী পক্ষের শুনানির পর বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য রেখেছে।

এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর সব পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত বিষয়টি রোববার আদেশের জন্য রেখেছিল।

সেই ধারাবাহিকতায় বিষয়টি রোববার আদেশের জন্য উঠলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার রিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অন্যদিকে আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির রিটের এখতিয়ারের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন।

পরে বিষয়টি ২৯ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য রেখে আদালত বলে, চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল ওইদিন বক্তব্য দিতে পারবেন।

শুনানি শেষে আইনজীবী শিশির মনির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছিলেন আইনজীবীদের এ রিট মামলা করার এখতিয়ার নেই। সেই প্রশ্নে আজকে আমি আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের নয়টি রায় দেখয়েছি। এই মামলাগুলো আইনজীবীরা করেছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্ট সেগুলো গ্রহণ করে নিয়েছে।

“আরেকটি বিষয় ছিল রিট করার আগে আবেদনকারীরা বিটিআরসির কাছে প্রতিকার চেয়েছিলেন কিনা। আমরা বলেছি, বিটিআরসিকে উকিল নোটিস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিটিআরসি কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। আবেদনকারীরা যদি বিটিআরসিতে নাও যান, তার পরেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮৬ ধারা অনুযায়ী বিটিআরসি স্ব-উদ্যোগে এসমস্ত বিষয় তদন্ত করতে পারে। কিন্তু তারা সেটি করেনি। এই ছিল আমাদের মূল কথা।”

এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বরের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন রিট অবেদনেকারীদের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

শুনানিতে তিনি বলেছিলেন, যারা রিট আবেদনটি করেছেন, তারা আইনজীবী। আবেদনকারীরা ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এ কারণে তাদের এই রিট আবেদন করার ‘আইনগত এখতিয়ার’ নেই।

“কারো ফোনালাপ ফাঁস হলে তিনি বিটিআরসি আইন অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আইনেই মামলা করতে পারেন। ক্ষতিপূরণ চাওয়ার সুযোগ আছে। প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আইন থাকায় জনস্বার্থে রিট আবেদন করার সুযোগ নেই। তাছাড়া যাদের ফোনলাপ ফাঁস হয়েছে তাদের কেউ এসে কিন্তু রিট আবেদনটি করেননি। কেউ এসে বলেনি, তার ব্যক্তিগত গোপণীয়তা লঙ্ঘন হয়েছে।”

বিটিআরসির আইনজীবী খোন্দকার রেজা-ই-রাকিব সেদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য সমর্থন করে বলেছিলেন, “আইনে যদি প্রতিকারের সুযোগ না থাকত তবে সংবিধান অনুযায়ী এই রিট আবেদন করার সুযোগ অছে। যেহেতু আইনে প্রতিকারের সুনির্দিষ্ট বিধান আছে, তাই রিট আবেদন করার সুযোগ নেই।”

আড়ি পাতা রোধে ও ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ঘটনা কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে গত ১০ আগস্ট হাই কোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী। এর অগে গত ২২ জুন বিটিআরসির চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিস দিয়েছিলেন তারা।

ফোনে আড়ি পাতা প্রতিরোধে আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পদক্ষেপ জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই নোটিসে। সে নোটিসের জবাব না পাওয়ায় তারা রিট আবেদনটি করেন।

রিটে ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত আড়ি পাতার ২০টি ঘটনা তুলে ধরা হয়, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ফোনালাপ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ফোনালাপ, প্রয়াত আইনজীবী মওদুদ আহমদ এবং রাজশাহী মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসানের ফোনালাপ, ভিকারুননিসা নূন কলেজের অধ্যক্ষের ফোনালাপ, মামুনুল হকের ফোনালাপ, যশোর-৬ আসনের সাংসদ শাহীন চাকলাদারের ফোনালাপ, ফরিদপুর-৪ আসনের সাংসদ মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের ফোনালাপ, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হকের ফোনালাপ রয়েছে।

রিটে আবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে চিঠিপত্র ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা সংরক্ষণ নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সংবিধানে এ অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে যেসব মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ আছে তার মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা সংরক্ষণ অন্যতম।

“তাছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ৩০ (চ) ধারা অনুযায়ী টেলিযোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু এ ধরনের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অথচ দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী কমিশনের দায়িত্ব হল ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ নিশ্চিত করা।”

২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট হাই কোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণও এই রিটে তুলে ধরা হয়েছে।

ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও সেবা প্রদানকারী কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব সর্বাধিক। সংবিধান ও আইন অনুযায়ী ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সংরক্ষণ তাদের দায়িত্ব। তারা আইনের বিধান ব্যতিরেকে ব্যক্তিগত যোগাযোগের তথ্য প্রদান করতে পারে না।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৩০ (১) (চ) ধারা এবং সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, সেই প্রশ্নে রুল চাওয়া হয় রিটে।

এছাড়া আদালত রুল জারি করলে তা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় কমিটি গঠন করে ফাঁস হওয়া ব্যক্তিগত ফোনালাপের ঘটনাগুলো তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সচিব এবং বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে রিটে বিবাদী করা হয়েছে।