রোহিঙ্গা সমস্যার চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে আফগান সঙ্কট: মিয়া সেপ্পো

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আফগানিস্তান সঙ্কটে নিবদ্ধ থাকায় রোহিঙ্গা সমস্যার চ্যালেঞ্জ ‘বেড়ে যাচ্ছে’ বলে মনে করছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Sept 2021, 10:30 AM
Updated : 19 Sept 2021, 03:08 PM

রোববার ফরেইন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিক্যাব) আয়োজিত সংলাপে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

আফগানিস্তান সঙ্কট রোহিঙ্গা সমস্যা থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্য দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি-না, ডিক্যাব টকে এমন প্রশ্ন রাখা হয়েছিল মিয়া সেপ্পোকে।

উত্তরে তিনি বলেন, “রোহিঙ্গা সঙ্কটকে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হিসাবে মনে করেন অনেকে। এটা বাস্তবতা যে, আফগানিস্তান এই সময়ে বড় রকমের মনোযোগ পাচ্ছে এবং তা এখানকার চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে।”

নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় জাতিসংঘের দূত বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী কোনো সঙ্কটে বৈশ্বিক মনোযোগ ধরে রাখা যে চ্যালেঞ্জের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখন কোনো সঙ্কট কক্সবাজারের মত দীর্ঘ মেয়াদী ও বড় রকমের সঙ্কটের আকার পায়, তা নিরসনে সম্পদের যোগান দেওয়াও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

”রোহিঙ্গা সঙ্কট যাতে ভুলে যাওয়া কোনো ঘটনায় পরিণত না হয়, সেজন্য সবার দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ তার কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় কাজ করছে। বাংলাদেশের বন্ধু, দাতাসংস্থা ও জাতিসংঘসহ অন্যদেরও এক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে।”

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট থেকে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা ।

এতে আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখের বেশি, জেলার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে।

জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ এই রোহিঙ্গাদের খাবার ও আশ্রয়ের মত মৌলিক প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে আসছে গত চার বছর ধরে। কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ততই কমে আসছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তিতে সই করলেও তাদের প্রস্তুতির অভাব আর রোহিঙ্গাদের আস্থার সঙ্কটে তা আর এগোয়নি।

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার যে কার্যক্রম সরকার শুরু করেছে, তা নিয়ে শুরুতে আপত্তি থাকলেও এখন জাতিসংঘ সেই কার্যক্রমে যুক্ত হতে যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কতটা অগ্রগতি হয়েছে জানতে চাইলে মিয়া সেপ্পো বলেন, আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। সরকারের উদ্যোগ ও এনজিওগুলোর সেবা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে জাতিসংঘ।

১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসান চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

”যখনই সমঝোতা স্মারক সই হবে, তখনই আমরা এই কাজে সম্পৃক্ত হব। জাতিসংঘ কীভাবে এই কাজে সম্পৃক্ত হবে, তা ঠিক করতে কাজ চলছে এখন।”

ভাসানচরের পরিস্থিতি নিয়ে মিয়া সেপ্পো বলেন, “ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার বিশাল বিনিয়োগ করেছে, যার লক্ষ্য ছিল ওই এলাকাকে বাসযোগ্য করা। শরণার্থী সুরক্ষা সংস্থা হিসাবে ইউএনএইচসিআরও তা চায়। সরকারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে।”

রোহিঙ্গাদের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয় যুক্ত করে বিশ্ব ব্যাংকের একটি কাঠামো প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এ প্রসঙ্গে মিয়া সেপ্পো বলেন, “আমি মনে করি, বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নের শর্ত নিয়ে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝি আছে। শরণার্থীদের বিষয়ে তহবিল দিতে বিশ্ব ব্যাংকের একটি বৈশ্বিক কাঠামো আছে। এক্ষেত্রে সামাজিক অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিও তাদের অর্থায়নের ক্ষেত্রে থাকে, তার মানে এই নয় যে বিশ্ব ব্যাংক বা জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে।

” জটিল এই (রোহিঙ্গা) সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের নিজস্ব নীতি রয়েছে। সুতরাং বুঝতে হবে, সর্বব্যাপী একটি তহবিল ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হবেই।”

তিনি বলেন, জাতিসংঘ যখন বলে সামাজিক সংহতি, তা সব সময় সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বোঝায় না। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যতক্ষণ বাংলাদেশে আছে, তারা ফেরার আগ পর্যন্তই বিষয়টি কার্যকর হবে।

আর বৈশ্বিক নীতির সংগে শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা দেশের নীতি যে সব সময় মিলবে না, তুরস্ক, উগান্ডা, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশও যে শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা আলাদাভাবে নিজেদের মত করে করেছে, সে কথাও বলেন মিয়া সেপ্পো।

”গ্লোবাল পলিসি সবার জন্য একইভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রিসোর্স মোবিলাইজেশনের জন্য ফান্ডিংয়ের দরকার। বিশ্ব ব্যাংকের এই তহবিল রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সবারই উপকারে লাগতে পারে। আমাদের প্রত্যাশা, এই সংলাপ চালু থাকবে। এটা সামাজিক সংহতির (social cohesion) বিষয়, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নয়।”

তিনি বলেন, শরণার্থীদের জন্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে বিশ্ব ব্যাংকের বড় অংশীদার ইউএনএইচসিআর। বৈশ্বিক নীতি তৈরির পেছনেও ইউএনএইচসিআর অংশীদার। আন্তর্জাতিকভাবে ভালো উদাহরণগুলো এই নীতির ভিত্তি। কিন্তু বৈশ্বিক ও স্থানীয় নীতি বেশিরভাব ক্ষেত্রে একরকম হয় না, আর তখনই জটিলতা হয়।

”বৈশ্বিক নীতির ক্ষেত্রে আমরা বিশ্ব ব্যাংকের মত একই অবস্থানে। কিন্তু বাংলাদেশে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আলোচনা প্রয়োজন। বৈশ্বিক নীতি ও স্থানীয় বাস্তবায়নের বিষয়কে আলাদা করে দেখতে হবে।”