গত রোববার স্কুল খোলার পর দেখা যাচ্ছে, রাজধানী ঢাকার নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে না হলেও গরিবের ছেলে-মেয়েরা পড়ে, এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটিকে ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনুপস্থিত।
একই চিত্র ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত জেলায়ও। সেখানেও সবাই শ্রেণিকক্ষে ফেরেনি।
মহামারী অভিঘাতে পরিবারে আর্থিক সঙ্কট, মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া, ছেলেদের কাজে যোগ দেওয়ার মতো ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের একটি অংশের শ্রেণিকক্ষে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম দেখছেন শিক্ষকরা।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত রোববারই স্কুল খুলেছে।
এরপর বিভিন্ন স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব শিক্ষার্থীর শ্রেণি কক্ষে না ফেরার বিষয়টি জানা গেলেও এর সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি।
বুধবার নরসিংদী সফরে যাওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুককে এ নিয়ে প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
জবাবে তিনি বলেন, “ঝরে পড়া শিক্ষার্থী সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তথ্য জানতে প্রতিদিন ডাটাবেইজ তৈরি করা হচ্ছে, সব প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়ার পর দ্রুতই এ সম্পর্কে জানা যাবে।”
ঢাকার রূপনগরের কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল ও কলেজের শ্রেণিকক্ষে এখন গড়ে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম।
মিরপুর ১২ নম্বরের কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলে মহামারীর আগে যে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল, স্কুল খোলার পর তার অর্ধেকেরও কম সংখ্যক শিক্ষার্থী ফিরেছে।
ঢাকার পল্লবীর গোল্ডেন ফিউচার স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন জানান, স্কুলটিতে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৩০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এখন শিক্ষার্থী আসছে ৬০ থেকে ৬৫ জনের মতো।
এই শিক্ষকের আরেকটি প্রতিষ্ঠান প্যারাডাইস কিন্ডারগার্টেন ও হাইস্কুলে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে ৫০০ জন শিক্ষার্থী থাকলেও এখন ১৫০ জনকে পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে উপস্থিতি থাকছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশের মতো।
মহামারীর মধ্যে অনলাইন অনলাইন ক্লাসে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ উপস্থিতি থাকত বলে জানান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক নূরে আলম।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম জানান, তারা ৮৫ শতাংশের মতো উপস্থিতি পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, “বাচ্চাদের বাসায় ভালো লাগছে না বলে ওরা এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে। ক্লাসে আসার আগ্রহ অনেক বেশি।”
ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথমদিন ৯৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় দিন ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এই প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রিন্সিপাল আসমা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পরীক্ষার্থীরা প্রায় সবাই আসছে। অনলাইনে ক্লাসে যত ভালো ইন্টারনেটই থাকুক না কেন, কিছু কথা শুনতে পাই কিছু কথা পাই না। সেটার চেয়ে সরাসরি ক্লাস অনেক ভালো।
“তাছাড়া বাসায় আবদ্ধ থাকা, নিঃসঙ্গ থাকার চেয়ে ক্লাসে সবার সাথে থাকাটা ভালো। সেদিক থেকে তারা স্কুলটাকে বেশি প্রেফার করছে।”
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া জানান, তাদের শিক্ষার্থী উপস্থিতি এখন ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ।
অনলাইন ক্লাসের শুরুর দিকেও তারা ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী পেয়েছিলেন, যা পরে ৫০ শতাংশে নেমে যায়।
আবু সাঈদ বলেন, যারা এসএসসি পরীক্ষার্থী, তাদের আগ্রহ অনেক বেশি। তাদের উপস্থিতিও বেশি।
তিনি বলেন, “ঢাকায় বড় স্কুলগুলো থেকে আসলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা, যেসব পরিবার সঙ্কটে আছে, শিক্ষার্থীরা পরিবার চালাতে অন্য কাজে চলে গেছে- তারা ঝরে পড়বে।”
খবর নিয়ে জানা গেল, নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ, দশম শ্রেণির ৭০ ভাগ, সপ্তম শ্রেণির ৮৫ ভাগ ও ষষ্ঠ শ্রেণির ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্লাসে ফিরেছে।
বাকিদের উল্লেখযোগ্য অংশ ঝরে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা স্কুলটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসলাম উদ্দিনের।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার মঙ্গলকাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দ্বীপ নারায়ণ দাশ জানান, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী পাচ্ছেন তারা। তবে পঞ্চম শ্রেণীতে উপস্থিতি প্রায় ৮০ শতাংশ।
স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট না থাকায় স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসের বাইরে ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন যারা বাইরে আছে, তাদের অনেকে আবার আসবে। তবে সবাই ফিরে আসবে কি না, বলা যাচ্ছে না।”
লালমনিরহাটের আদিতমারি উপজেলার সাপ্টিবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০-২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসের বাইরে রয়েছে।
এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ মো. তাজুদ্দিন বলেন, “শিক্ষার্থীদের কেউ বাইরে, কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, কেউ আবার ঢাকায়। তাদের কিছু সংখ্যক ঝরে যাবে। যারা আসছে না, তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করছি।”
২০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছে রাজবাড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও।
ডিভাইস না থাকায় অনলাইন ক্লাসে ২০ শতাংশের বেশি উপস্থিতি ছিল না জানিয়ে এখনকার উপস্থিতিকে সন্তোষজনক বলছেন প্রতিষ্ঠানটি প্রধান শিক্ষিকা মাহবুবা আক্তার।
“যারা এসেছে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে, সেটা দেখে আমাদেরও খুব ভালো লেগেছে। যারা আসছে না, তাদের অনেককে ফোন করেছি। ওরা আসবে বলে আমরা আশা করছি।”
শেরপুর সদরের ৬৭ নম্বর খাসপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সাহানাজ পারভীন জানান, ৮০ শতাংশের মত উপস্থিতি পেয়েছেন তারা, অনলাইন ক্লাসে যা ছিল ৫০ শতাংশের কম।
“ওরা এতদিন পরে স্কুলে এসে অনেক খুশি। অনেকে হয়ত বেড়াতে গেছে, ওরাও চলে আসবে। অনেকের বাবা-মায়ের সাথে ফোনে যোগাযোগ করছি। আশা করছি তারা ঝরে পড়বে না।”
কেন তারা নেই?
ঢাকার রূপনগরের কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল ও কলেজের প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলামের আশঙ্কা, তার প্রতিষ্ঠানের যে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত, তার বড় অংশই আর শ্রেণিকক্ষে ফিরবে না।
“অনেকে গ্রামে চলে গেছে। কিছু মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা সবাই স্বচ্ছল না। তাই কিছু শিক্ষার্থী হয়ত ঝরে পড়বে।”
ঢাকার পল্লবীর গোল্ডেন ফিউচার স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন তার অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে বলেন, “অনেকের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে গেছে। সংসার চালাতে কাজে যোগ দিয়েছে। অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। কেউ আবার ভাড়া দিয়ে চলতে পারছে না বলে গ্রামে চলে গেছে।”
কিডজ ক্যাম্পাস স্কুলের পরিচালক রাকিব হাসানও বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে অনেকের আয় কমে গেছে। স্কুলে আসলে তো খরচ হবে, বেতন দিতে হবে। সে কথা ভেবেও স্কুলে পাঠাচ্ছে না বাবা-মায়েরা।
“আবার ভাবছে, তিন মাসের জন্য স্কুলে পাঠিয়ে কী করবে? একেবারে আগামী বছরে পাঠাবে। অনেকে গ্রামে শিফট হয়েছে। তাই শিক্ষার্থী কম আসছে।”
নরসিংদীর বেলাব উপজেলার দেওয়ানের চর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ইসলাম উদ্দিন তার অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ফিরে পাওয়া নিয়েও সংশয়ী।
“অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে, অনেকে চাকরি করে, অনেকে রিকশা-ভ্যান চালায়। বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিই- অ্যাসাইনমেন্ট দেয় না কেন? বাড়ি থেকে বলে- গার্মেন্টসে চলে গেছে, এসে জমা দিবে। পরে কেউ কেউ অ্যাসাইনমেন্ট পাঠায়।”
তিনি জানান, অনলাইন ক্লাসে মাত্র ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পেতেন তারা।
“বিদ্যুৎ থাকত না, মোবাইল নাই, নেট কেনার সক্ষমতা নাই, নেটওয়ার্কের সমস্যা- এসব কারণে আমরা অনলাইন ক্লাসে তেমন রেসপন্স পেতাম না।”
ক্লাসে না আসা শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়বে কি না, সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে অন্তত সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরে আলম।
তিনি বলেন, “এরপরই আমরা অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের ক্লাসে ফিরিয়ে আনব।”
[এই প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নরসিংদী প্রতিনিধি বেনজির আহমেদ]