রুদ্ধশ্বাস এক যাত্রায় কাবুল থেকে ঢাকায়

বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আটকে গেল তাদের দেশে ফেরার যাত্রা; আরেকটি দলের সঙ্গে বিশেষ ফ্লাইটে ফেরার পরিকল্পনা হলেও বিমানবন্দরে পৌঁছাতে হবে গোলাগুলি, ব্যারিকেড আর তালেবানের চেকপোস্ট পেরিয়ে।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2021, 05:49 PM
Updated : 13 Sept 2021, 05:51 PM

একমাত্র চালু থাকা কাবুল বিমানবন্দরে ঢোকার প্রথম প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় বোমা হামলার সতর্কতায়। দ্বিতীয় দিন তারা যখন বিমানবন্দরের দিকে রুদ্ধশ্বাস যাত্রায়, তখন ওই এলাকা কেঁপে ওঠে আত্মঘাতী বোমা হামলায়।

তৃতীয়বারের চেষ্টায় আফগান ওয়্যারলেস কোম্পানিতে কর্মরত ছয় বাংলাদেশি কাবুল ছাড়তে পারলেও ফাঁকা গুলি আর যুদ্ধাবস্থা পেরিয়ে আসতে হয় তাদের।

এই বাংলাদেশিদের একজন প্রকৌশলী রাজিব বিন ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সেই প্রাণপণ যাত্রার কথা।

তিনি বলেন, সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মনোবল তারা হারাননি, ‘বিশ্বাস ছিল’ কোনোভাবে বিমানবন্দরে ঢুকতে পারলে একটা ব্যবস্থা হবে দেশে ফেরার।

আফগানিস্তানের প্রথম ও সবচেয়ে বড় মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আফগান ওয়্যারলেসের কর্মকর্তা প্রকৌশলী রাজিব। আফগান-আমেরিকান কোম্পানিটির পিবিএক্স ও কন্টাক্ট সেন্টার পরিচালন বিভাগের প্রধান তিনি।

২০০৭ সালের নভেম্বরে আফগান ওয়্যারলেসে যোগ দেন ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির এই স্নাতক। শুরুতে এই কোম্পানিতে অনেক বাংলাদেশি কাজ করলেও এখন আছেন ৯ জন। বর্তমানে শ’খানেক বিদেশি কর্মরত আছেন ওই প্রতিষ্ঠানে।

অগাস্ট মাসের শুরু থেকে ঝড়ো গতিতে তালেবান যখন একে একে আফগানিস্তানের প্রদেশগুলো দখল করে কাবুল ঘিরে আসছিল, তখনও নিজেদের কাজের মধ্যেই ছিলেন রাজিবরা।

কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকায় ১৪ অগাস্ট তাদের কোম্পানি সিদ্ধান্ত নেয় বিদেশি কর্মীদের আফগানিস্তানের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার।

রাজিব ও তার পাঁচ বাংলাদেশি সহকর্মীর জন্য এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ১৬ অগাস্টের টিকেট কাটা হয়। কোভিড- ১৯ পরীক্ষাসহ দেশে ফেরার প্রস্তুতির মধ্যেই ১৫ অগাস্ট রাতে খবর আসে কাবুল বিমানবন্দর থেকে সব বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ।

সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে রাজিব বলেন, “১৫ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমরা রিপোর্ট হাতে পাই, আমাদের সবার কোভিড টেস্ট নেগেটিভ আছে কিন্তু তার আধা ঘণ্টা পর আমরা এমিরেটস থেকে মেইল পাই, এমিরেটসের ফ্লাইটগুলো কাবুল থেকে স্থগিত করা হয়েছে।”

তালেবান কোনো লড়াই ছাড়াই ১৫ অগাস্ট পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর জালালাবাদ দখল করে নিয়ে কাবুলকে কার্যত ঘিরে ফেলে। দিনের পরবর্তী সময় তারা রাজধানী কাবুলে প্রবেশ করতে শুরু করে।

তালেবান যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশের পর রক্তপাত এড়াতে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ ঘোষণা আসে সরকারের তরফ থেকে।

প্রকৌশলী রাজিব বলেন, “১৫ তারিখ দুপুর থেকে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম, বর্তমান ক্ষমতাসীন যে দল বিভিন্ন জায়গায় শহরে ওদের দেখা যাচ্ছে, এই খবরে আমাদের লোকাল কলিগসহ সবার মধ্যে কিন্তু একটা প্যানিকড সিচুয়েশন তৈরি হয়।”

বিভিন্ন প্রদেশে আফগান বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের যুদ্ধ থেকে প্রাণে বাঁচতে আগে থেকে কাবুলে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখার কথা জানান তিনি। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী লাখো মানুষ ছিলেন সেই মিছিলে।

“মানুষ সিটির ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিল, সবার ধারণা ছিল অন্য দিকে দখল হয়ে আসলেও কাবুলে যেহেতু প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস এখানে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে বা কাবুল ঢুকতে হয়তো কিছুটা সময় লাগতে পারে”- বলেন রাজিব।

১৬ অগাস্ট দেশের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল রাজিব ও তার সহকর্মীদের। কিন্তু চালু থাকা একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল লাখো আফগান নাগরিক।

সেই দিনের কথা মনে করে রাজিব বলেন, “বুঝতে পারছি, এই পরিস্থিতিতে যাওয়া তো দূরের কথা, ফ্লাইট নামারই সুযোগ নাই। এমন অবস্থা ছিল ১৫-১৬ তারিখে।

“আমরা চিন্তা করলাম, একটু অপেক্ষা করি, এয়ারপোর্টের পরিস্থিতিটা একটু নর্মাল হোক, ভেতরের মানুষ যদি এয়ারপোর্ট থেকে না সরে তাহলে কমার্শিয়ার ফ্লাইট বলেন অথবা অন্য কোনো ফ্লাইট বলেন দু’টা কিন্তু রানওয়েতে নামতে পারবে না।”

কাবুল দখলের পর রকেট লঞ্চার হাতে টহলে এক তালেবান যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

ফেরার ব্যর্থ চেষ্টা

বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ থাকার মধ্যে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের ১৬০ আফগান শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশেষ ফ্লাইটে ফেরার পরিকল্পনা হয় রাজিবসহ মোট ১৪ বাংলাদেশির।

২৫ অগাস্ট কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে রওনা হন আফগান শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশিরা। কিন্তু রাস্তায় ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড পেরিয়ে এবং দীর্ঘ অপেক্ষার পরও তারা সফল হননি।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জারি করলে সেদিন তাদের কাবুল বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়।

এর মধ্যে বিমানবন্দরে ঢোকার চেষ্টা তাদের চলতে থাকে বলে জানালেন রাজিব। পশ্চিম দিকের বেসামরিক ফটক বন্ধ থাকায় বিমানবন্দরে ঢোকার একমাত্র পথ বিপরীত দিকের সামরিক ফটক।

নির্দেশনা অনুযায়ী সাতটি বাসে সেই ফটকের দিকে রওনা হয় ১৭৪ জনের দলটি। মূল ফটকে ঢুকতে হলে প্রথমে পার হতে হবে তালেবানের পাহারা; সেখান থেকে অনুমতি মিললে কিছু দূরে মার্কিন বাহিনীর অনুমোদন নিয়ে ঢুকতে হবে ভেতরে।

বিমানবন্দরে ঢোকার চেষ্টার কথা তুলে ধরে রাজিব বলেন, “আমরাও গেটের আশেপাশে ছিলাম, ব্যাপারটা হলো আমরা ঢোকার জন্য অ্যাটেম্প করতেছিলাম।

“আরেকটা ব্যাপার হলো, গেটের সামনে গেলে ঢুকতে দেবে এমনও না। কারণ প্রথম ব্যারিকেডটা ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন যারা তাদের, এরপর ১৫-২০ ফিট পরে গিয়ে মার্কিন বাহিনীর। তার মানে হচ্ছে এয়ারপোর্ট ঢুকতে হলে বর্তমান দলের ব্যারিকেড পার হতে হবে, তারপর অন্য গেট পার হতে হবে।”

এসব ব্যারিকেড পার হতে গিয়ে আফগানদের পাশাপাশি অনেক বিদেশিকে ফিরে আসতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

রাজিব বলেন, “আমাদের সাথে যেহেতু আফগান স্টুডেন্টরা ছিলেন, বাসগুলো গেটের দিকে গেছে, প্রথম দিকে বিভিন্ন অনুমতির ব্যাপার ছিল, যেহেতু এতজন মানুষ ওরা যাবে, একটু পারমিশানের ব্যাপার ছিল এবং ভিড়েরও ব্যাপার ছিল। সবকিছু মিলিয়ে নিরাপত্তার খাতিরেও আমরা ঢুকতে পারি নাই।”

সামরিক ফটক দিয়ে ঢুকতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই দলটির কাছে নির্দেশনা আসে বাণিজ্যিক ফটকের দিকে যাওয়ার।

এ বিষয়ে রাজিব বলেন, “বিকালের দিকে আমরা যখন ঢুকতে পারি নাই, আমাদেরকে আরেকটা ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হলো যে, বাণিজ্যিক গেট, যেটা নর্মালি বন্ধ থাকে, স্পেশাল পারমিশন নেওয়া হয়েছে, তোমরা ওই গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা কর।

“আমরা এয়ারপোর্টের পেছনের দিকের গেট থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা ড্রাইভ করে সামনের দিকে আসতেছিলাম।”

২৬ অগাস্ট তাদের এই মরিয়া চেষ্টার মধ্যে কাবুল বিমানবন্দরের সামনে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১৩ মার্কিন সৈন্য ও আরও দুই শতাধিক জন নিহত হন। জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করে।

প্রকৌশলী রাজিব বলেন, “বাণিজ্যিক গেটের ৪-৫ মিনিটের দূরত্বে থাকার সময় আমরা কলিগদের মাধ্যমে জানতে পারি, আমরা যে গেইটে ছিলাম সেই গেইটে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। আমাদেরকে ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হলো, যেহেতু এয়ারপোর্টের আশেপাশে গোলাগুলি হচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য।”

বিস্ফোরণের পর নিজেদের আশেপাশে ও দূর থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাওয়ার কথাও জানান তিনি। বিমানবন্দরের সামনের সড়কে প্রতিবন্ধকতা থাকায় তারা সামনে এগোতে পারেননি।

রাজিব বলেন, “ওখানেই আমাদের গাড়িগুলো সাইড করে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। রোড ব্লক যখন ছাড়বে, তখন হয়তো আমরা আবার এয়ারপোর্টের দিকে যেতে পারব।

“কিন্তু যেহেতু এই রকম একটা সিচুয়েশন তৈরি হলো, এত হতাহত, গোলাগুলি, প্রায় ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা গোলাগুলি হয়েছে। আমাদের আশেপাশেও গোলাগুলি হয়েছে। আমরা গাড়ি থেকে নামি নাই। যেহেতু সিচুয়েশন ভালো না, কোথায় নামব, কোথায় গোলাগুলি হয়।”

অপেক্ষার এক পর্যায়ে রাতে তাদেরকে বলা হয় বাণিজ্যিক ফটকের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতে। কিন্তু তাতেও বেশিদূর যাওয়া সম্ভব হয় না এই দলটির।

প্রকৌশলী রাজিবের ভাষায়, “আমরা আবার অগ্রসর হতে থাকি, তারপর ওখানে একটা রোড ব্লক দেওয়া থাকে, ওখান থেকে আমাদেরকে আর যেতে দেয় না, সিকিউরিটি রিজনে আমাদের গাড়িগুলোকে ওরা ঘুরিয়ে দেয়।

“সেখান থেকে রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে ফেরত আসি। আমরা রাস্তাতেই থাকি, ব্যারিকেড হয়তো রাত্রের বেলা খুলবে। তাহলে আমরা ২-৩ ঘন্টা পরে যদি আরেকটা অ্যাটেম্প নিতে পারি।”

কিন্তু দলটির সাতটি বাসের মধ্যে পাঁচটি ঘুরিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে চায় জানিয়ে তিনি বলেন, “দুটা বাসের দিকে লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়, সে কারণে চালকরা ভয় পায়, তারা রাত্রের বেলা আর এয়ারপোর্টের দিকে যেতে চায়নি।”

ওই রাতে তারা সবাই থাকার জায়গায় ফিরে আসেন। তবে ফেরার সময় তালেবান যোদ্ধাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয় তাদের।

সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে রাজিব বলেন, “রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড ছিল, আমাদের গাড়িগুলোকে থামানোও হয় এবং এক জায়গাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ওরা ওঠে।

“জিজ্ঞেস করল আমরা কোথায় গিয়েছিলাম? আমাদের পরিচয় দেওয়ার পর ওরা আমাদের বাস ছেড়ে দেয়, পরে আমরা আমাদের কম্পাউন্ডে ফেরত যাই।”

কাবুল থেকে পালাতে মার্কিন বিমান। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন ফ্লাইটে উদ্ধার

পরের দিন ২৭ অগাস্ট শুক্রবার আফগান শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা হয়ে আফগান ওয়্যারলেসে নেপালি কয়েক সহকর্মীর সঙ্গে বিমানবন্দরের পথ ধরেন রাজিবসহ ছয় বাংলাদেশি।

রাজিবের সঙ্গে বাংলাদেশি সহকর্মীদের মধ্যে আফগান ওয়্যারলেসের বিএসএস অ্যান্ড আরএস বিভাগের পরিচালক মো. কামরুজ্জামান, সিনিয়র ম্যানেজার (পাওয়ার অপারেশনস) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম, সিনিয়র মাইক্রোওয়েভ ইঞ্জিনিয়ার ইমরান হোসাইন, সহকারী ম্যানেজার (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি) আবু জাফর মো. মাসুদ করিম, পাওয়ার সুপারভাইজার শেখ ফরিদ উদ্দিন ছিলেন ওই যাত্রায়।

রাজিব বলেন, “আমরা পরের দিন আমাদের কোম্পানির যে ছয়জন বাংলাদেশি, আরও কিছু নেপালি কলিগ ছিল, ওদের সাথে আমরা পরের দিন নিজেরা যাই এবং পাসপোর্ট ও ডকুমেন্ট শো করি, তারপর নিজেদের মতো আমরা ভেতরে ঢুকি।

“ভেতরে ইউএস আর্মির লোকজন থাকেন, তাদের কাছে অ্যাপ্রোচ করি যে, আমাদের পাসপোর্ট আছে, আমরা বাংলাদেশি, আমরা এখানে মোবাইল কোম্পানিতে কর্মরত। তখন ওরা ওদের সবচেয়ে রিসেন্ট অ্যাভেইলেবল ফ্লাইট যেটা ছিল, ওটাতে আমাদেরকে অ্যাকোমোডেট করে দেয়।”

রাজিব বিন ইসলাম ও তার সহকর্মীরা।

প্রায় ৬০০ যাত্রীর ওই ফ্লাইট প্রথমে জার্মানি যাওয়ার কথা থাকলেও পরে গন্তব্য পরিবর্তন হয়ে কাতারের দোহায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে অবতরণ করে।

দুপুর বেলা দোহায় পৌঁছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মাশফী বিনতে শামসের মাধ্যমের ঢাকায় ঢাকায় যোগাযোগ করেন তারা। প্রায় ২৪ ঘন্টা সামরিক ঘাঁটিতে থাকার পর কাতারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা তাদেরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হোটেল হায়াত রিজেন্সিতে নিয়ে যান।

দুই দিন ওই হোটেলে অবস্থান করার মধ্যে আফগান ওয়্যারলেসের পক্ষ থেকে রাজিবদের টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়। ৩১ অগাস্ট রাতে দোহা থেকে দুবাই হয়ে ঢাকায় পৌঁছান তারা।

মরণপণ চেষ্টার মধ্যেও মনোবল না হারানোর কথাই জানান, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ুয়া রাজিব বিন ইসলাম।

তিনি বলেন, “আমাদের একটা ভাবনা ছিল আমরা এয়ারপোর্টে ঢুকতে পারলে তখন আমরা আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা যার সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন হবে, আমরা এয়ারপোর্টের ভেতর থেকে করতে পারব। ভাবছিলাম যে, আমরা একটা না একটা বন্দোবস্ত করতে পারব। এতটুকু বিশ্বাস ছিল।”

এখন ঢাকা থেকে রাজিব ও তার সহকর্মীরা অনলাইনে কোম্পানির কাজ সারলেও পুনরায় আফগানিস্তানে ফেরার বিষয়ে অনিশ্চিত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে তাদের।

এ বিষয়ে রাজিব বলেন, “আমরা এটা ওভারকাম করে দেশে আসতে পেরেছি। এখন আমরা দেশে থেকে কাজ করছি, যতদিন সরকার গঠন হয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে আসা পর্যন্ত এখন আমরা দেশে থেকেই কাজ করব।

“পরবর্তীতে আমাদের সরকার ও কোম্পানি যখন মনে করবে যে, সিচুয়েশন সকল কিছু স্থিতিশীল আছে, আমাদের অন্যান্য দেশের লোকজনও ফিরবে কাজের জন্য, অন্য দেশের কলিগ, দূতাবাস যখন সবাই মনে করবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে, আমরা ফেরত যেয়ে আবার জয়েন করতে পারি।”

রাজিব বিন ইসলাম ও তার সহকর্মীরা।

রাজিবের দেখা আফগান জীবনমান

১৪ বছরের কর্মজীবনে পরিবর্তিত আফগানিস্তানের এগিয়ে চলা কাছ থেকে দেখেছেন রাজিব; বিচ্ছিন্ন সংঘাত হলেও সাধারণ আফগানদের জীবনযাত্রার মান স্বাভাবিক দেখার কথা জানান তিনি।

রাজিব বলেন, “জীবনযাত্রার মান খুবই স্বাভাবিক। আমরা স্বাভাবিকভাবে দেখেছি, ওরা শান্তিপ্রিয় জাতি, ওরা যুদ্ধ বা সংঘাতের মতো ব্যাপারগুলো পছন্দ করে না। কারোরই আসলে যুদ্ধটা কাম্য না।”

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থল নারী-পুরুষের অবস্থান এবং পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণত বাংলাদেশের মতো মধ্যমপন্থি মুসলিম দেশের সঙ্গে তুলনীয় বলেই জানান রাজিব।

তিনি বলেন, “ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেমন যাচ্ছে, কর্মক্ষেত্রেও ছেলে এবং মেয়েরা ওদের সামাজিকতা বিচার করে যেভাবে ওদের পোশাক পরিচ্ছদ প্রয়োজন, মুসলিম দেশ হিসাবে জেনারেলি সবাই হিজাব পরিধান করে, মুসলিম দেশ হিসাবে যেটা করা প্রয়োজন।

“আবার রক্ষণশীল সমাজও দেখেছি, ওরা বোরকা পরিধান করে, যেটা আমাদের দেশেও প্রচলিত আছে। সো ব্যাপারগুলো খুবই স্বাভাবিক।”

রাজিব বলেন, “রাস্তাঘাটেও দেখেছি, আমাদের ছেলেমেয়েরা যেভাবে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে, আফগানিস্তানেও সেইম। জীবনযাত্রার মানের দিকে চিন্তা করলে আমাদের তেমন পরিবর্তন চোখে পড়েনি।”

ক্ষমতায় আসার পর তালেবান বলছে, নারীদের পড়াশোনা ও চাকরির সুযোগ দেওয়া হলেও তা থাকবে ইসলামি শরীয়ার মধ্যেই।

এ প্রসঙ্গে আফগানফেরত প্রকৌশলী রাজিব বলেন, “বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আসার পরে ভীতি কাজ করেছে যে, আগের মানুষজন যেভাবে চলাফেরা করেছে বা মেয়েরা স্বাধীনভাবে অফিস-আদালতে কাজ করেছে বা স্কুল-কলেজে গিয়েছে, সবার মধ্যে এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে, তারা আগের মতো অফিসে বা স্কুলে যেতে পারবে কি-না, এই ভয়ভীতিগুলো এখনও বিরাজ করবে।”

পুরো প্রক্রিয়াটা তালেবান সরকারের কাজ পূর্ণোদ্যমে শুরু হওয়ার পরই বুঝা যাবে বলে অন্যদের মতো মনে করছেন তিনি।

“তবে আমরাও আমাদের লোকাল কলিগদের মাধ্যমে যতটুকু জানতে পেরেছি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা মিডিয়াতে মেয়েরা কিছু কিছু কাজে যোগদান করছে”- বলেন রাজিব।