কেউবা বন্ধুর হাত ধরে দৌড়ে বেড়িয়েছে স্কুলের প্রিয় প্রাঙ্গনে, কেউবা শ্রেণিকক্ষেই মেতেছেন গল্পে, কাউকে কাউকে দোলনায় দোল খেতেও দেখা গেছে প্রিয় বন্ধুটির সঙ্গে।
ক্লাশ শেষেও কথা যেন ফুরাচ্ছিল না কারও কারও। তাইতো বারান্দার প্রাচীরে বসেও পুষিয়ে নিচ্ছিলেন দীর্ঘ বিরতির অভাবটা।
রোববার দেড় বছর পর স্কুলে যাওয়ার পর থেকে শেষ পর্যন্ত মাঠে, শ্রেণিকক্ষে সবর্ত্রই কোমলমতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসের প্রকাশ ছিল দেখার মত।
ক্লাস শেষে তারা বলছেন, দেড় বছর পর শ্রেণিকক্ষে ফিরে প্রিয় বন্ধু ও শিক্ষককে কাছে পেয়ে প্রথম দিনটা আনন্দেই কেটেছে তাদের।
করোনাভাইরাসের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ এই বন্ধ শেষে বন্ধুদের কাছে পেয়ে অন্য রকম ভালো লাগাই কাজ করেছে তাদের মধ্যে। ভাইরাসের কারণে আবার যেন বিচ্ছেদের মধ্যে পড়তে না হয় সে কামনাও করেছেন অনেকে।
তবে সংক্রমণ যেহেতু এখনও শেষ হয়ে যায়নি তা নিয়ে উদ্বেগও কাজ করছে অভিভাবক ও শিক্ষকদের মনে।
হাসি মুখে সে বলেছে, “আমার খুল ভাল লাগছে। এতদিন তো বাইরে বের হওয়া যেত না। তবে কখনও কখনও একটু একটু বের হয়েছি। আজ প্রিয় অনেক বন্ধুদের কাছে পেয়ে ভাললাগা কাজ করছে। বহুদিন পর স্যার-ম্যামদেরকেও একসাথে দেখছি, অনেক ভাল লাগছে।”
আরেক শিক্ষার্থী আম্রিন জাহান আরিফা বলেছে, “এতদিন তো বাসা বের হতে পারিনি, অনলাইন ও মোবাইল ফোনে ম্যাম-স্যার যেসব পড়া দিয়েছেন, তা শেষ করেছি। এখন থেকে ক্লাসে বসে পড়া যাবে, প্রতিদিন বন্ধুদের সাথে দেখা হবে। অন্যরকম ভাল লাগছে।”
আর যাতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ না বাড়ে, সেই প্রত্যাশা মুহাম্মদ আলিফ নামে আরেক শিক্ষার্থীর।
তার ভাষ্য, “ঘরে বসে থাকা ভাল লাগে না, বন্ধুদের সাথে দেখা হয় না। কখনও কখনও অ্যাসাইমেন্ট জমা দিতে স্কুলে এসে কারও সাথে দেখা হয়েছে। সবাই একসাথে দেখা হওয়ার মত ব্যবস্থা হয়নি। এখন যাতে ভাইরাসের সংক্রমণ না বাড়ে সেই আশা করি। স্কুল যাতে আর বন্ধ না হয়ে যায়।”
কেমন ছিল পরিবেশ
রোববার বেশিরভাগ স্কুলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ঢাকার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদেরকে সরব উপস্থিতি দেখা গেছে।
ঢাকার কয়েকটি বিদ্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা মেপে শিক্ষার্থীদের স্কুলে প্রবেশ করানো হয়। বিদ্যালয়ের ভেতরে হাত ধোয়ার জন্য বেসিন বসিয়ে পর্যাপ্ত পানি ও সাবান রাখা হয়েছে।
এছাড়া কেউ মাস্ক ছাড়া আসলে তার জন্য স্কুল থেকেই মাস্ক দেওয়া হচ্ছে।
নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্রতিটি বেঞ্চে সর্বোচ্চ দুইজন করে শিক্ষার্থী বসাতে দেখা যায়। খোলার প্রথম দিনের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর বেশি আলোচনা করেছেন শিক্ষকরা।
বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি শ্রেণিকক্ষে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। ক্লাসের সব শিক্ষার্থীদের মুখে মাস্ক পরা ছিল। ক্লাস কক্ষগুলো ছিল বেশ পরিপাটি।
এ স্কুলের বাইরে বেসিনে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিদ্যালয়ের মাঠও বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে।
কী পড়িয়েছেন শিক্ষকরা
৫৪৩ দিন বিরতির পর প্রথম দিন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে সন্তোষ জানিয়েছেন শিক্ষকরাও।
তারা বলছেন, এখন থেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি সরকারের নির্দেশিত রুটিন অনুযায়ি অনলাইনেও ক্লাস হচ্ছে।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছিলেন সহকারী শিক্ষক ফাতেমা-তুজ-জোহরা।
প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের কী পড়ানো হচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা দুই/একদিন বেশি বেশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ক্লাস নিচ্ছি। তার সাথে ক্লাসের অন্যান্য বিষয়গুলো পড়ানো হবে।”
“যে কারণে তারা পড়াশোনা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তবে যে বাচ্চাটি বা তার অভিভাবক অনলাইন থেকে দূরে ছিল তার জন্য একটু সমস্যা হয়ে গেছে। এদেরকে আমরা একটু বেশি যত্ন করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।”
বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রওশন জাহান জানান, তার স্কুলে ৮১৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ১০৭ জন। তারা এবার পিএসপি পরীক্ষায় অংশ নেবে।
“আমাদের চিন্তা হল সব শ্রেণির শিক্ষার্থীকে পড়াশোনায় নিয়মিত করানো। সেই জন্য আমরা চেষ্টা করে যাব। তবে সপ্তাহ দুই গেলে বোঝা যাবে সংক্রমণ পরিস্থিতি কোনদিকে যাচ্ছে। এ সময়ের মধ্যে যাতে কোনা বাচ্চা আক্রান্ত না হয়, সেই প্রত্যাশা করছি।”
বাইরে অপেক্ষা মায়েদের, কিছুটা উদ্বেগও
দীর্ঘ বিরতির পর বাচ্চারা আবার ক্লাশে শিখবে বলে তাদেরকে স্কুলে পাঠানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। তবে কোভিড সংক্রমণের মধ্যেই ক্লাস শুরু হওয়ায় তাদের স্কুলে পাঠিয়ে উদ্বেগ ও দুঃশ্চিতাও কাজ করছে বলে জানিয়েছেন একাধিক অভিভাবক।
নাদিরা ইসলাম চৈতিকে ক্লাসে পাঠিয়ে স্কুলের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন তার মা শামীমা নাসরিন।
প্রায় দেড় বছর স্কুল বন্ধের সময় বাসায় মেয়ের পড়াশোনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “স্কুল থেকে অনলাইনে যতটুকু পড়ানো হত তা সম্পন্ন করার চেষ্টা করেছি।”
স্কুল খোলা হলেও এখনও সংক্রমণের হার কম নয় বলে ‘একটু দুঃচিন্তা’ কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, “ক্লাসের ভেতর মেয়ের ব্যাগে হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে রেখেছি। বাসায় তো একটু পর পর হাত ধোয়ানোর অভ্যাস করেয়েছি। এখন ক্লাসে বসে একটু পর পর যেন স্যানিটাইজ করে।”
সচিবের পরিদর্শন
রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম নগরীর বেশ কিছু বিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সচেতনমূলক বেশ কিছু পরামর্শ দিতে দেখা যায় তাকে।
ক্লাসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে হাসিবুল আলম বলেন, “আমাদের নির্দেশনা হল- স্কুলের ভেতর ও বাইরের পরিবেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। করোনার থেকে সচেতনার পাশাপাশি ডেঙ্গুতেও যাতে কেউ আক্রান্ত না হয় সেই দিকে নজর রাখতে বলছি।”
“ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাসে উপস্থিত হয়, সেই জন্য হাত ধোয়া, তাপমাত্রা মাপা, মাস্ক দেওয়ার জন্য বলেছি। এই জন্য প্রতিটি বিদ্যালয় যেত স্লিপ ফান্ডের অর্থ থেকে এই ব্যয় করে সেই বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী স্কুল খোলার প্রথম দিন রুটিনে পঞ্চম ও তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষে ক্লাস রেখেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদানের জন্য শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুপুর ১২টা ৫ মিনিট পর্যন্ত ক্লাস রাখা হয়েছে।
তবে কোনো স্কুলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বেশি হলে দ্বিতীয় শিফট চালু করার নির্দেশনাও রয়েছে। এক্ষেত্রে দুপুর দেড়টা থেকে পৌনে ৪টা পর্যন্ত ক্লাস নিতে বলা হয়েছে।