প্রথমবার স্কুলে যাওয়া, স্কুল ড্রেসে নিজেকে প্রথম দেখা, একই বেঞ্চে বসে প্রথম বন্ধুত্ব, কিংবা স্কুলের মাঠে প্রথমবার খেলতে নামার ঘটনাগুলো স্মৃতি হয়ে থাকে সারা জীবন।
কিন্তু দুনিয়াজুড়ে অভূতপূর্ব এক মহামারীর এই কালে অনেক শিশুর শিক্ষাজীবন শুরুই হয়েছে অনলাইনে।
বাংলাদেশের স্কুলপড়ুয়াদের জীবনে ১২ সেপ্টেম্বর বিশেষ এক দিন। করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে দেড় বছর ঘরবন্দি থাকার পর এদিন স্কুলে ফিরেছে তারা।
আর মাইশা, ইকরা, ফারনাজ, তোহা, আবদুল্লাহর মত শিশুদের কাছে রোববার ছিল প্রথম স্কুল আবিষ্কারের দিন।
স্কুলের খাতায় তাদের নাম উঠেছিল আগেই। বছরের শুরুতে, সেই জানুয়ারি মাসে মিরপুরের এডুকেয়ার হাতেখড়ি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল তারা। কিন্তু তখনও স্কুল ছিল বন্ধ। তাই এতদিন শুধু অনলাইনেই ক্লাস হয়েছে।
এই শিশুদের কাছে স্কুল মানে ছিল এক অচেনা জগত। সকাল সকাল ঘড়ি ধরে স্কুলে ছোটার তাগিদ তারা রোববারই প্রথমবার পেল। ছোট্ট ব্যাগে বই-খাতা, টিফিন নিয়ে সত্যিকারের স্কুলে পা রাখা এতদিন তাদের কাছে ছিল স্বপ্নের মত।
ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে গত বছরের মার্চ মাসে বন্ধ করে দেওয়া হয় দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাতে রাতারাতি বদলে যায় শিশুদের শৈশব। ডিজিটাল দুনিয়ায় স্কুলের ধারণাও পাল্টে যায়।
গতবছরের শুরুতে যারা ভর্তি হয়েছিল, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তারা খুব অল্প দিনই পেয়েছে। আর চলতি বছর যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের তো স্কুলে পা রাখার সুযোগই আগে হয়নি।
স্কুলের শিক্ষকদের সাথে এই শিশুদের দেখা হয়েছে কেবল স্মার্টফোন আর ল্যাপটপের স্ক্রিনে, সেই ডিভাইসের ভেতর থেকেই ভেসে এসেছে অ-আ, ক-খ আর হোমওয়ার্কের নির্দেশনা। ক্লাস-পরীক্ষা আর শিক্ষক-সহপাঠী, সবকিছুই চলছিল ডিজিটাল সীমানার নয়া রীতির স্কুলে গণ্ডি মেনে।
যে শিশুরা প্রযুক্তি বঞ্চিত, সেই সুযোগও তাদের মেলেনি। সেই হিসেবে মাইশা, তোহা, আবদুল্লাহরা ভাগ্যবান।
রোববার তারা পরিচিত হয়েছে স্কুল বেঞ্চ আর বোর্ডের সঙ্গে। এতদিন যে মিসরা ছিলেন জুম ভিডিওর ছবি, তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে সামনা-সামনি। সবচেয়ে বড় কথা, পরিচয় হয়েছে ক্লাসের বন্ধুদের সঙ্গে, এতদিন অনলাইন ক্লাসে যারা ছিল কেবল এক একটি নাম।
মিরপুরের এডুকেয়ার হাতেখড়ি স্কুলে দেখা হল নার্সারির ক্লাসের এই ১০ নবীন পড়ুয়ার সঙ্গে। স্কুলের প্রথম দিনটা তাদের কেমন কাটল?
মাইশা জানালো, স্কুলে আসতে পেরে সে ‘অনেক খুশি’। নাম জিজ্ঞেস করতেই বানান করে বলা শুরু করল। এই ক্ষুদে শিক্ষার্থীর চোখের হাসিই বলে দিচ্ছিল তার প্রথম স্কুলে আসার অনুভূতি।
নার্সারি ক্লাসে ফারনাজই কেবল স্কুল ড্রেস পরে এসেছে। তার মা জাকিয়া জানালেন স্কুলে আসার আগের রাতের প্রস্তুতির কথা।
“স্কুল খোলার কথা শুনে তো ও খুবই খুশি। কবে স্কুলে যাবে- সেই অপেক্ষায় ছিল। কাল রাতে স্কুল ড্রেস পরে ওর বাবাকে, আমাকে দেখাচ্ছিল- কেমন লাগছে।
“সকালে নিজেই ঘুম থেকে উঠে গেছে স্কুলে যাওয়ার জন্য। অনলাইনে ক্লাসে তো সরাসরি ক্লাসের আনন্দ নেই। সরাসরি ক্লাস অন্যরকম বিষয়।”
ইকরা জাহানের ড্রেস এখনও বানানো হয়নি, তাই সে স্কুল ড্রেস পরতে পারেনি। তবে তাতে তার স্কুলে আসার আনন্দ কমেনি। সরাসরি জানিয়ে দিল, অনলাইনের ক্লাসের চেয়ে সরাসরি ক্লাসই ভালো।
“অনলাইনে তো কাউকে দেখাই যেত না। এই ক্লাসটাই বেশি ভালো।“
সন্তানের প্রথম ক্লাসে আসার দিনটির জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিলেন অভিভাবকরাও। স্কুল বন্ধ থাকায় শৈশবের আনন্দ হারিয়ে যেতে বসেছিল বাচ্চাদের। বন্দিদশায় হাঁপিয়ে ওঠা এই শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি মানসিক বিকাশ ও সামাজিকতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছিল অভিভাবকদের মনে।
অভিভাবকরা জানালেন, এতটুকু বাচ্চারা অনলাইন ক্লাসে কিছুই বুঝতে পারত না। ধৈর্য হারাত মাঝপথেই। উল্টো তাদের তৈরি হয়েছে ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি।
নার্সারির এক শিক্ষার্থীর মা জান্নাতুন্নেসা স্বর্ণা জানালেন, তার মেয়েকে অনলাইনে ক্লাস করাতে হত জোর করে। কিন্তু ক্লাস শেষে তার হাত থেকে মোবাইল ফেরত পাওয়া যেতে না।
“ক্লাস শেষে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে বসত। মোবাইলের অভ্যাস হয়ে গেছে একদম। মোবাইল দেখলেই সেটা নিতে হবে।”
শিশুদের দুরন্তপনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গমগম করবে- সেজন্য অপেক্ষায় ছিলেন শিক্ষকরাও। দীর্ঘদিনের বিরতি কাটিয়ে তারা যেন দ্রুত মানিয় নিতে পারে, সেই চেষ্টাই এখন তারা করবেন।
মাইশারা আরও এক দিক দিয়ে ভাগ্যবান। সরকারিভাবে রোববার প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরানো শুরু হলেও প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এখনও ডাকা হয়নি। তবে অভিভাবকদের অনুরোধে এডুকেয়ার হাতেখড়িসহ কিছু কিন্ডারগার্টেন রোববারই ক্লাস শুরু করেছে।
এই স্কুলের পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন বললেন, “বড় ভাই বা বোন যখন স্কুলে যায়, ছোটরাও যেতে চায়। সেই জায়গাটা থেকে অভিভাবকদের অনুরোধে তাদের স্কুলে এনেছি।”
অনলাইন ক্লাসে যে শিশুদের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে, সে কথা জানিয়ে তিনি বললেন, “বাচ্চারা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের সপ্তাহে এক-দুইদিন করে স্কুলে নিয়ে আসতে। এই ছোট বাচ্চাদের জন্য সরাসরি ক্লাসটা খুব জরুরি। অনলাইনে হাতেখড়িটা সেভাবে হচ্ছে না।
“আমরা রিডিং পড়ানো শেখাচ্ছি। কিন্তু অনলাইনে ওদের অক্ষর লেখা শিখাতে পারছিলাম না। এই বাচ্চাদের স্কুলে ফেরানো জরুরি। কারণ এই বাচ্চাদের দেড় বছর নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের তো এতদিনে লেখা শিখে ফেলার কথা।”