জমি দখলের জন্য রাজারবাগের পীরের ‘কেরামতি’, স্তম্ভিত আদালত

বাড়ি আর জমির দখল নিতে ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার এক বাসিন্দার বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, মানবপাচারের মত নানা অভিযোগে ৪৯টি মামলার পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে।  

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2021, 12:43 PM
Updated : 12 Sept 2021, 02:05 PM

রোববার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।

ওই প্রতিবেদন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম বলেন, “বাংলাদেশে পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেব কী করেছেন দেখেন! সম্পত্তির জন্য তথাকথিত মুরিদ দিয়ে মামলা করিয়েছেন। পীর সাহেবের কেরামতি দেখেন!”

ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, চুরি-ডাকাতি, মানবপাচারের মত নানা অভিযোগে ৪৯টি মামলা হয়।

মারামারির এক মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ অগাস্ট সূত্রাপুর থানা পুলিশ একরামুল আহসান কাঞ্চনকে গ্রেপ্তার করে। এরপর দুই বছর তিন মাস তিনি কারাগারে ছিলেন। এর মধ্যে ১৭টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।

২০১৫ সালের ২১ মে জামিনে বেরিয়ে আসেন কাঞ্চন। পরে আরও বিভিন্ন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন।

গত বছর অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জের যুগ্ম জেলা জজ আদালতে কাঞ্চনের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে ৪৯তম মামলাটি করা হয়।

এ অবস্থায় ‘অস্তিত্বহীন’ বাদীর ২০টি মামলা চ্যালেঞ্জ করে গত ৭ জুন হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন ৫৫ বছর বয়সী কাঞ্চন। সেসব মামলার বাদীকে খুঁজে বের করতে তদন্তের নির্দেশনা চাওয়া হয় রিটে।

গত ১৪ জুন প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট পাঁচ দফা নির্দেশনাসহ  রুল দেয়। আবেদনকারীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ ফৌজদারি মামলা দায়েরে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।

এছাড়া একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ‘হয়রানিমূলক’ মামলা দায়েরের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।

আদেশ পাওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

ওই ২০ মামলার মধ্যে মানবপাচার, মারামারি, অ্যাসিড নিক্ষেপের পাঁচ মামলার বাদী গত ৫ সেপ্টেম্বর হাই কোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন। আপিল বিভাগ ৫ মামলার ক্ষেত্রে হাই কোর্টের আদেশটি স্থগিত করে দেয়। 

পরদিন, অর্থাৎ গত ৬ সেপ্টেম্বর সিআইডির  প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাই কোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়।

সেদিন ফতুল্লায় মারামারির মামলার বাদী রাজারবাগ দরবার শরীফের সহকারী বাবুর্চি আফজাল হোসেনের আইনজীবী মো.অজিউল্লাহ জানান, পাঁচটি মামলার ক্ষেত্রে হাই কোর্টের আদেশ আপিল বিভাগে স্থগিত হয়েছে। পরে হাই কোর্ট সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের অনুলিপি নিয়ে আসতে বলে রোববার বিষয়টি আদেশের জন্য রাখে।

সে অনুযায়ী মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে দুই পক্ষের আইনজীবীই বলেন, তারা আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি সংগ্রহ করতে পারেননি।

তখন শুননি এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি রেখে সিআইডির অনুসন্ধান প্রতিবেদনটি সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আনতে আইনজীবীদের নির্দেশ দেন বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম।

আদালতে রিটকারী কাঞ্চনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এমাদুল হক বশির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার। আর মামলাকারী আফজাল হোসেনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. অজিউল্লাহ।

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এক বোন। তাদের বাবা চিকিৎসক আনোয়ারুল্লাহ ১৯৯৫ সালে মারা যান।

বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তর-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্ন সময় প্ররোচিত করেও মুরিদ করা যায়নি।  

রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনেই ৩ শতাংশ জমির ওপর তিন তলা পৈতৃক বাড়ি কাঞ্চনদের। পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হওয়ার পর কাঞ্চনের মা, ভাই-বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির বেশিরভাগ অংশ পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়।

কাঞ্চন ও বাদলের অংশও দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়।

কিন্তু কাঞ্চন ও তার ভাই সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ‘হয়রানিমূলক’ মামলা দায়ের করেন।

সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে জিআর (পুলিশি মামলা) মামলা ২৩টি এবং সিআর (নালিশি মামলা) মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে ১৫টি জিআর মামলা এবং ২০টি সিআর মামলায় কাঞ্চন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন।

বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন, যার মধ্যে আটটি জিআর এবং ছয়টি সিআর মামলা।

পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, “অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, হত্যার চেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

“মামলাগুলোর নথি পর্যালোচনা এবং বাদী ও ভিকটিমদের সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী, ভিকটিমগণ কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরীফ এবং ওই দরবার শরীফের পীরের সহিত সম্পৃক্ত।”

এছাড়া ২০২০ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একটি তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাজারবাগের দরবার শরীফের পীর দিল্লুর রমান এবং তার অনুসারীরা তাদের দরবার শরীফের স্বার্থ হাসিলের জন্য নিরীহ জনসাধারণের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করে আসছে মর্মে তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছেন।”

রিট আবেদনকারী কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ‘মিথ্যা ও হয়রানিমূলক’ মামলা দায়েরের পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীদের ‘অশুভ স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে’ জানিয়ে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

সিআইডির এই প্রতিবেদন দেখে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, “জায়গা জমির জন্য মুরিদ দিয়ে মামলা করবে- এটি কি কথা হল? মুরিদের ঠিকানা দিয়ে মামলা করেছে। একটি মিথ্যা মামলা দিলেই তো মানুষের জীবন শেষ হয়ে যায়। সেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা দিলেন! এটাতো সিরিয়াস ব্যাপার।”

সিআইডির প্রতিবেদনে উঠে আসা অভিযোগের বিষয়ে জানতে পীর দিল্লুর রহমানের দরবারের মুখপাত্র, দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার সম্পাদক মুহম্মদ মাহবুব আলমকে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।