হৈ হুল্লোড়ে, আনন্দে হারালো স্বাস্থ্যবিধি

মাস্কঢাকা মুখে তাপমাত্রা মেপে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ, দূরত্ব মেনে ক্লাস করা- কোভিড নিয়ে সতর্কতার উল্টো চিত্রও দেখা গেছে মহামারীর কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর রোববার চালু করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Sept 2021, 12:37 PM
Updated : 12 Sept 2021, 04:13 PM

শিক্ষার্থীদের পদচারণায় যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে রাজধানীর বিদ্যালয়গুলো। তবে চেনা পরিবেশ বদলে গেছে অনেকটা। মহামারীর শঙ্কায় যেমন সতর্কতা গেছে, তেমনি শিশুদের আনন্দ-উৎসব আর অভিভাবকদের জটলায় তা হারিয়েও গেছে।

মহামারীতে ৫৪৩ দিন ঘরবন্দি থেকে রোববার সকাল থেকে স্কুলে-কলেজে ফিরতে শুরু করেছে শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল সাজানো হয়েছে।

তাপমাত্র মেপে স্কুলে প্রবেশ, মাস্ক পড়ে ক্লাসে ঢোকা, দুরত্ব মেনে ক্লাসে বসানো হলেও ক্লাসের বাইরের পরিবেশ ভিন্ন। দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের পেয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দের শেষ ছিল না।

বন্ধুদের দেখেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছেন তারা। মাস্ক খুলে দেখেছেন একে অন্যকেও। লাইন ধরে স্কুলে প্রবেশ করলেও শিক্ষার্থীদের মাঝে দূরত্ব ছিল খুবই কম।

রূপনগরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে (ব্যাঞ্চ-১) গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল রঙিন কাগজ আর বেলুনে সাজানো হয়েছে। লাইন ধরে শিক্ষার্থীরা তাপমাত্রা মেপে, হাত স্যানিটাইজ করে থার্মাল স্ক্রিনিং করে স্কুলে প্রবেশ করছে।

আর স্কুলের বাইরে অনেক শিক্ষার্থীকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। অনেকেই জটলা করে গল্প করছে, হাসি-ঠাট্টায় স্বাস্থ্যবিধির কথা ভুলেই যাচ্ছিলেন তারা।

অনেকে আবার স্কুলের বাইরের ফুচকা-চটপটি, ঝালমুড়ির দোকানে ভিড় করছেন। আগের সেই পরিচিত পরিবেশ ফিরে পাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তারা। দশম শ্রেণীর ৮-১০ জন শিক্ষার্থীদের কয়েকজন মাস্ক খুলেই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন।

এদেরই একজন বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিয়া বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি তো ক্লাসে মেনেছি। দূরে দূরে বসেছি। এক বেঞ্চে দুজন করে বসেছি। এখন তো বাইরে। অনেকদিন পরে দেখা হল। কারও চেহারা-হাসি মাস্কের কারণে দেখতে পাচ্ছি না। তাই মাস্ক খুলে একটু গল্প করছি।”

আরেক শিক্ষার্থী সাদিয়া বলেন, “সব সময় তো দূরত্ব মেইনটেইন সম্ভব হয় না। এই যে আমরা দুজন একসাথে রিকশায় এসেছি।”

দশম শ্রেণীর মাহি সকালে ঘুম না ভাঙায় স্কুলে আসতে না পারলেও বন্ধুদের জন্য আড্ডা দিতে চলে এসেছেন।

মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের ক্লাস সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয়ে শেষ হয়েছে ১১টায়। আর ছাত্রদের ক্লাস শুরু হয়েছে বেলা ১২টায়। দুটি পৃথক গেইট দিয়ে আলাদাভাবে ছাত্র ও ছাত্রীদের প্রবেশ করানো হয়েছে।

দশম শ্রেণির রেদওয়ানুল ইসলামও বহুদিন পর বন্ধুদের পেয়ে হাত মিলাচ্ছেন, জড়িয়ে ধরছেন।

স্বাস্থ্যবিধির কথা তুললে তিনি বলেন, “এতোদিন পরে দেখা হল, আর জড়িয়ে ধরব না? মাস্ক তো পরে আছি।”

এই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আহনাফ, তাহসিন আর নাইম মাস্ক খুলেই গল্প করছিলেন। স্কুলে ফিরতে পেরে খুশি হলেও মহামারীর এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারছেন না তারা।

আহনাফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগে তো কখনও মাস্ক পরে আসতে হয়নি। এখন তো পরিবেশ একদম আলাদা। কিন্তু এমন হলেও ক্লাসটা যাতে বন্ধ না হয়। অনলাইনে ক্লাস ভালো লাগে না।”

স্কুলের ভেতরে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়েছে, তা যেন বজায় থাকে সেদিকে নজর দিতে বলেছেন অভিভাবকরা।

এই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সাইফের মা বলেন, “এখন যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে সেটা যেন সবসময় থাকে। দুইদিন পরই যাতে আবার সব বন্ধ না হয় সেদিকটাতে নজর দিতে হবে।”

এই স্কুলের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হাজেরা পারভীন বলেন, এখানে তাপমাত্রা মেপে স্যানিটাইজ করে বাচ্চারা আলাদা আলাদা সিড়ি গেইট দিয়ে স্কুলে ঢুকেছে। আলাদা সেকশন আলাদা সিড়ি ব্যবহার করেছে।

মনিপুর স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষক তাসমিয়া জেরিন জানান, সোয়া দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মেপেছেন।

স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে তিনি বলেন, “বাচ্চারা স্কুলে তো মেনে চলেছে। প্রথমদিন বলে হয়ত বাইরে স্বাস্থ্যবিধিটা হয়ত একটু কম মেনেছে।”

মিরপুরের কামাল আহমেদ মজুমদার স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে একই দৃশ্য দেখা যায়।

স্কুলের গেইটের বাইরে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। একসাথে জড়ো হয়ে গল্প করতে দেখা গেছে।

বন্ধুর কাঁধে হাতে দিয়ে হাঁটছিলেন পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আরিয়ান। তিনি বলেন, “কাছাকাছি থাকলে তো অসুবিধা নাই। মাস্ক তো পরে আছি। কিচ্ছু হবে না। স্কুলে তো সব মেনেই ঢুকেছি। বসেছিও দূরে।”

সন্তানকে স্কুল থেকে নিতে আসা তানিয়া ইসলাম বলেন, “বাচ্চারা বাসায় থাকতে থাকতে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। স্কুলে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। বাইরে তো কিছুটা এমন হবেই।”

এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম বলেন, “আমরা স্কুলের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মানার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কিন্তু বাইরে তো আমরা ওদের ধরে রাখতে পারব না। আর দীর্ঘদিনের বন্দী জীবন থেকে আজকে ওরা মুক্তি পেয়েছে। ওরা তো হুড়োহুড়ি করবেই। বাচ্চাদের ধর্মই এটা।”

এই স্কুলের শ্রেণীকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থীকে বসানো হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মুখে রয়েছে মাস্ক।

রূপনগর সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। তবে স্কুলের বাইরে কিছু শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যবিধি মানায় ছিল অনীহা।

এই স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর অভিভাবক নূরে জান্নাত বলেন, “আপনি কি একেক জনকে ধরে স্বাস্থ্যবিধি মানাইতে পারবেন? জোর করে তো কিছু করা যাবে না। স্কুল খুলছে, এতেই বাচ্চাদের শান্তি। বাচ্চারা একটু এমন করবেই। এই পরিবেশ তো ওরা আগে পায় নাই।”

স্কুল খোলায় খুশির পাশাপাশি মাস্ক পরে বন্ধুদের দেখতে ভালো লাগছে না এই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর সৌরভের।

তিনি বলেন, “স্কুল আসতে পেরেছি এতে খুব ভালো লাগছে। কিন্তু সবাই আলাদা আলাদা, সবার মুখে মাস্ক দেখতে ভালো লাগছে না।”

শিক্ষার্থীদের মত অভিভাবকরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায় ছিলেন। স্কুলে স্কুলে অভিভাবকদের যে ভিড় ছিল, তাতে স্বস্তির চিত্রই ছিল বেশি।

মিরপুরের এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউটের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, “ঘরে বসে থেকে বাচ্চারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এখন স্কুল খুলছে, পরিস্থিতি যাতে ভালো থাকে, আর বাচ্চারা যাতে স্কুলে আসতে পারে। বাচ্চারা স্কুলে আসতে পেরে অনেক খুশি।”

মিরপুর ১২ নম্বরের লিটল ফ্লাওয়ারস স্কুল ও ঢাকা আইডিয়াল প্রিপারেটরি স্কুলের সামনে শিক্ষার্থীদের চেয়ে অভিভাবকদের ভিড় ছিল বেশি। তাদের কারও কারও মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। আর সামাজিক দূরত্বও মানতে দেখা যায়নি।

লিটল ফ্লাওয়ারস স্কুলের অভিভাবক শাহ আলম বলেন, “স্কুল থেকে বলে দিছে বাচ্চাদের নিয়ে যেতে। আর স্কুলের সামনে তো জায়গা কম। এখানে না দাঁড়ালে বাচ্চারা আমাদের দেখবে কেমনে? দূরে দাঁড়ানো সম্ভব না।”