মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তাইয়্যেবা জাহানের কাছে অনেক লম্বার বিরতির পর স্কুল শুরুর এই ক্ষণগণনা আনন্দ-আয়োজনেই রূপ নিয়েছে।
আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরতে প্রস্তুতিও শেষ। শনিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে জানায়, আগের স্কুল ড্রেস হয়নি, জুতাটাও ছোট হয়ে গেছিল। প্রথম দিনই স্কুলে উপস্থিত থাকতে তাই আগেভাগে সব কিছুই করেছে এই শিক্ষার্থী।
করোনাভাইরাস মহামারীর দেড় বছরের ঘরবন্দি অবস্থা শেষের সংবাদের পর থেকে তাইয়্যেবার মত উৎফুল্ল অন্য শিক্ষার্থীদেরও যেন আর তর সইছিল না।
সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হওয়া, একসঙ্গে ক্লাস করা, খুনসুটির সেই পুরনো ছন্দে ফিরতে মুখিয়ে তারা।
তবে সবারই প্রথম দিনে স্কুলে ফেরা হচ্ছে তা কিন্তু নয়। কেননা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনে একেক দিন একেক শ্রেণির ক্লাশ হবে। তাই স্কুলভেদে পঞ্চম, দশম ও দ্বাদশ ছাড়া অন্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রোমাঞ্চিত হওয়ার পালাটা আরেকটু দীর্ঘ হবে।
ব্যাগ নেওয়া যাবে না, টিফিন খাওয়া যাবে না- এমন বাধ্যবাধকতাসহ স্কুলে প্রবেশ থেকে শুরু করে বের হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনীয় অনেক দিক-নির্দেশনাও দিয়েছে কিছু স্কুল।
রোববার এমন পরিস্থিতিতেই মহামারীর অস্বাভাবিকতা পেছনে ফেলে ৫৪৩ দিন পর স্কুল-কলেজে ফেরার অপেক্ষা ফুরোচ্ছে শিক্ষার্থীদের। রাত পোহালেই দেশে এত দীর্ঘদিন সরাসরি পাঠদান বন্ধ রাখার ‘নজির’-এ পড়ছে ছেদ।
দীর্ঘদিনের অনভ্যস্ততা কাটিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই আবার শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে ড্রেস, খাতা-বই নিয়ে প্রস্তুত। এ নিয়ে গত কয়েকদিন ব্যস্ততা ছিল দর্জিপাড়ায়; বিক্রি বেড়েছে জুতা, বই-খাতা-কলম-পেন্সিলেরও।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরিস্থিতি ‘অনুকূলে’ না আসায় দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে আসছিল সরকার।
স্কুল-কলেজ খোলা নিয়ে সরকারের উপর নানা মহল থেকে চাপও বাড়ছিল। এরমধ্যে সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা নিম্নমুখী হলে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব দ্রুত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
এরপরই গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
তবে শ্রেণিকক্ষে ফিরতে শিক্ষার্থীদের মাস্ক পড়তে হবে এবং কেউ অসুস্থ থাকলে তাকে প্রতিষ্ঠানে না পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রতিটি স্কুল নজরদারি করা হবে এবং সংক্রমণ বাড়ার কারণ আছে মনে হলে প্রয়োজনে তা বন্ধ করা হবে।”
চলতি বছরের শেষভাগে এসএসসি ও এইচএসসির পাশাপাশি পঞ্চমের প্রাথমিক সমাপনী, অষ্টমের জেএসসি-জেডিস এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
স্বস্তির সঙ্গে উদ্বেগও আছে অভিভাবকদের
মহামারীকালে দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষ থেকে দূরে থাকলেও অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে এসেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে অনেক শিক্ষার্থীই এর বাইরে থাকায় সশরীরে ক্লাস নেওয়ার দাবি ছিল।
ফলে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্তে অনেক অভিভাবকই স্বস্তিবোধ করছেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে তাদের। সন্তানের সুরক্ষা নিয়ে চিন্তায় থাকা কিছু অভিভাবক সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামার আগে সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চান না।
“তবে স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে মানাটা খুব জরুরি। এই দিকটায় যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সচেতন হয়।”
স্কুলগুলোর প্রস্তুতি যেমন
স্কুল- কলেজ খুলতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আসার পর রাজধানীসহ সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চালানোর পাশাপাশি রুটিন তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছে।
হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, তাপমাত্রা মাপা, প্রয়োজনে মাস্ক রাখার ব্যবস্থাও নিয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
রাজধানীর নালন্দা স্কুল যেমন অভিভাবকদের জানিয়েছে, স্কুলে ব্যাগ নেওয়া যাবে না, স্কুলে ঢোকার মুখে মাস্ক বদলে নতুন মাস্ক পরতে হবে, স্কুলে সব সময় মাস্ক পরে থাকতে হবে, পানির বোতল নিতে হবে সুরক্ষিত কোনো মোড়কে, টিফিন খাওয়া নিষেধসহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়েই দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
স্কুলটি একদিন সশরীরে ক্লাশ নেবে এবং বাকি দিনগুলো অনলাইনে আগের রুটিনে শেণি কার্যক্রম চালাবে। ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় দুই ভাগে ভাগ করেছে।
রাজধানীর মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা কামাল খুশনোবীশ বলেন, "আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছি। শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় আছি এখন।
"স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেভাবে ক্লাস নেওয়া যায়, সেভাবেই নিব। আশা করি বাচ্চারা দ্রুত মানিয়ে নিতে পারবে।"
"শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো ঝুঁকিতে না পড়ে, সেদিকে আমরা নজর দেব। সরকারের নির্দেশনা মেনেই প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করা হয়েছে। যেহেতু সবগুলো ক্লাস প্রতিদিন আসবে না, তাই তেমন কোন সমস্যা হবে না আশা করছি।"
চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আয়েশা খাতুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরো প্রস্তুতি সম্পন্ন। স্কুলে আসবে জেনে শিক্ষার্থীরা খুব খুশি। আমরাও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি কখন তাদের ক্লাসে পাব।
“নির্দেশনা মোতাবেক সব ধরনের প্রস্তুতি হয়েছে; পরিচ্ছন্নতায় কিছু সময় লেগেছে। আশা করি, স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করতে পারব।”
চট্টগ্রাম জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই। করোনার কারণে শ্রেণি পাঠদান বন্ধ থাকলেও প্রাথমিকের শিক্ষক-কর্মচারীরা স্কুলে এসে আনুষাঙ্গিক কাজগুলো করেছেন।
“এক বেঞ্চে একজন করে শিক্ষার্থী বসবে। কোথাও শ্রেণিকক্ষ সংকট থাকলে দুই শিফটে ক্লাস হবে। আমাদের ৮৯ শতাংশ শিক্ষক ডবল ডোজ টিকা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে।”
তবে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
কোভিড সুরক্ষায় নির্দেশনা
মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছে সরকারও। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এজন্য ১৯ দফা নির্দেশনাও পাঠানো হয়েছে।
তাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ পথে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা, ভিড় এড়াতে প্রতিষ্ঠানের সব প্রবেশমুখ ব্যবহার করা, একটি প্রবেশমুখ থাকলে একাধিক প্রবেশমুখের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ আইসোলেশন কক্ষ হিসেবে প্রস্তুত রাখা, প্রতিষ্ঠানের সব কক্ষ, বারান্দা, সিঁড়ি, ছাদ, আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ওয়াশরুম নিয়মিত পরিষ্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করার নির্দেশনা রয়েছে।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে তাদের বসার ক্ষেত্রে তিন ফুট দুরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। খেলার মাঠ, ড্রেন ও বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে, কোথাও যেন পানি না জমে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতেও বলেছে শিক্ষা অধিদপ্তর।
এদিকে স্কুল-কলেজ খোলার পর শুরুতে দিনে দুটি করে ক্লাস রেখে রুটিন তৈরি করতে বলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
এছাড়াও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে চলমান ডিগ্রি, সম্মান ও মাস্টার্স পরীক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করে ২০২১ ও ২০২২ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্য রুটিন তৈরি করে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
রুটিন এমনভাবে প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে, যেন ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ, প্রস্থান ও অবস্থানের সময় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের মতো কোনো বিষয় যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রেখে রুটিন তৈরি করতে হবে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপাতত অ্যাসেম্বলি বা সমাবেশ বন্ধ থাকবে এবং প্রতিদিন নির্ধারিত চেকলিস্ট অনুযায়ী তথ্য পাঠাতে হবে।
সংক্রমণ বাড়লে আবার বন্ধ
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়লে পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।
শনিবার জামালপুরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাঠদান করলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সম্ভাবনা কম। তারপরও সংক্রমণ বেড়ে যাবার আশঙ্কা দেখা দিলে প্রয়োজনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফের বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ থাকলেও পড়াশুনা বন্ধ ছিল না। টেলিভিশন ও অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশুনা চালানো হয়েছে।”