বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণার পর আদালত থেকে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “তথ্য প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। এ আইন স্বাধীন মত প্রকাশে অবশ্যই বাধা। এ আইনে রদ করা উচিৎ।”
ফেইসবুকে লেখালেখির কারণে হুমকি পাওয়ার কথা জানিয়ে ২০১৫ সালে থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন শহীদ পরিবারের সন্তান প্রবীর সিকদার। কিন্তু পুলিশ তা নেয়নি বলে তার অভিযোগ।
পরে ওই বছর ১০ অগাস্ট এক ফেইসবুক পোস্টে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি লেখেন, ‘তার কিছু হলে’ তখনকার স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসের এবং ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার এবং তার অনুসারী-সমর্থকরা ‘দায়ী থাকবেন’।
এরপর ১৬ অগাস্ট সন্ধ্যায় রাজধানীর ইন্দিরা রোডের কার্যালয় থেকে প্রবীরকে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। রাতেই তাকে নেওয়া হয় ফরিদপুরে।
ফরিদপুরের এপিপি স্বপন পাল তার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় এই মামলা করেন। সেখানে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ‘সুনাম ক্ষুণ্ণের’ অভিযোগ আনা হয়।
সে সময় গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয় বিভিন্ন মহল থেকে।
ছয় বছর বিচার চলার পর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আসসামছ জগলুল হোসেন বৃহস্পতিবার এ মামলার রায়ে প্রবীর সিকদারকে খালাস দেন।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, যাদেরকে এ মামলায় ‘ভিকটিম’ বলা হয়েছে, তারা নিজেরা এ মামলা করেননি বা তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন কেউ এ মামলার বাদী নন। এমনকি তারা এ মামলায় সাক্ষীও ছিলেন না। মামলা করেছেন দূরের একজন, যার এ অভিযোগে মামলা করার এখতিয়ার নেই।
রায়ের পর সাংবাদিকদের সামনে প্রতিক্রিয়া দিতে এসে প্রবীর সিকদার বলেন, “আমি ন্যায়বিচার পেয়েছি। আমি একা হলেও ন্যায়ের জন্য লড়াই করব।
“আজ যে ন্যায় পেলাম, তার মর্যাদা রক্ষার জন্য আমার লড়াই অব্যাহত থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শেষ পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়ে থাকব। থাকব ঘাপটি মেরে থাকা রাজাকারদের নির্মূলের জন্য লড়াইয়ে।”
প্রবীর সিকদার উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ এবং দৈনিক বাংলা ৭১ নামের পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। তিনি এর আগে সমকাল ও কালের কণ্ঠে কাজ করেছেন। ২০০১ সালে দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি থাকার সময় সন্ত্রাসীর হামলায় গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছেন তিনি।
এই সাংবাদিকের অভিযোগ, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর `সহযোগী’ মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন লেখার কারণে ‘তার ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা’ ওই হামলা চালায়।
সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “একাত্তরে আমার বাবার মরদেহ পাওয়া যায়নি। কাকা, দাদু, মামাদের আমাদের চোখের সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এজন্য এই দেশটিকে বাবার কবরস্থান মনে করি। এই কবর স্থানের ওপর যারাই অসঙ্গতি করবে, অনিয়ম করবে, অন্যায় করবে তাদের বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করে যাব। আদালতের রায় আমার সাহস আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।”
এই মামলার কারণে ছয় বছর ধরে যে দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে প্রবীর বলেন, “ছয়টি বছর আমি লড়াই করে জিতেছি। কিন্তু আমার জীবন, আমার পারিবারিক জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে এনে ঢাকা শহরে খেতে হয়। কেউ আমাকে কাজ দেয় না। আমার নিজের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে ভয় পায়। এ রকম একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।”
তার ভাষায়, ‘আইনের কথা বলে প্রভাবশালীদের স্বার্থ রক্ষা’ করা হয়, এই মামলার কারণে তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ তার হয়েছে।
“আমার বয়স যাই হোক, পুলিশ কাস্টডিতে যে হয়রানি…, আমি থানায় গিযেছিলাম আইনের আশ্রয় নিতে। কিন্তু উল্টো আমি হলাম মামলার আসামি।”
এখন ক্ষতিপূরণের জন্য মামলা করবেন কি না- এমন প্রশ্নে প্রবীর সিকদার বলেন, “আদালত কিন্তু প্যাসিভলি এটা বলেছে, মিথ্যা মামলার বিষয়ে আইন রয়েছে। এ আইনে অধিকাংশ মামলা কিন্তু মিথ্যা।… আগে রায়ের কপি হাতে পাই, তারপর দেখব।”