তালেবানের আল কায়দা-যোগই ‘নিরাপত্তার হুমকি’

তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরলেও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য তার চেয়ে মূল হুমকি হিসেবে আল কায়দাকে চিহ্নিত করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকগোলাম মর্তুজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2021, 07:20 PM
Updated : 29 August 2021, 07:27 PM

তারা বলছেন, তালেবার আফগানিস্তান নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু তারা যদি আগের মতো আল কায়দাকে মদদ দেয়, তাতে এই জঙ্গি সংগঠনটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে। কারণ এই দলটি সব স্থানে তাদের সংগঠন বিস্তৃত করতে চায়, যে প্রবণতা তালেবানের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর আল কায়দা-যোগের জন্যই পাঁচ বছর পর তাদের উৎখাত হতে হয়েছিল।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ায় আফগানিস্তানে বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানে ক্ষমতা হারিয়েছিল তালেবান।

সেই অভিযানের দুই দশক পর যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা আফগানিস্তান মিশন পুরোপুরি শেষ করার সময়ে আবার দেশটির ক্ষমতা দখল করল তালেবান। গত ১৫ অগাস্ট রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর এখন দলটি সরকার গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছে।

তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফেরার বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। কেননা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উৎসভূমি এই আফগানিস্তানই।

পরিস্থিতি আসলে কতটা গুরুতর- প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উৎপত্তি হয়েছিল তালেবানদের পূর্ববর্তী শাসনামলে। তালেবানরা ক্ষমতায় ফেরায় এ ধরনের উগ্রপন্থিদের কার্যকলাপ তালেবান শাসকদের ছায়ায় আরও বেড়ে যেতে পারে।

কাবুল দখলের পর রকেট লঞ্চার হাতে টহলে এক তালেবান যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

“তালেবানদের সঙ্গে দেশীয় উগ্রবাদীদের সরাসরি যোগাযোগের একটা সম্ভাবনা ছাড়াও তালেবানদের বিজয়ের এই ঘটনা তাদের কাছে ‘আদর্শের বাতিঘরে’র মতো কাজ করতে পারে। সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতি দেশের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুদিক থেকেই ঝুঁকির কারণ হতে পারে।”

তালেবানে যোগ দিতে কিছু বাংলাদেশির আফগানিস্তান যাওয়ার খবর নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে উদ্বেগের মনে হলেও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান তেমন ভাবনার কিছু দেখছেন না।

তার ভাষ্য, বাংলাদেশ থেকে কেউ তাদের দলে যোগ দিতে পেরেছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

তালেবানের বিজয়ে সোশাল মিডিয়ায় কারও কারও যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “তারা হয়তো আদর্শের কারণে সমর্থন করতে পারে, অনুসারীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস আসতেও পারে। তার মানে এই নয় যে তাদের কিছু করার সক্ষমতা আছে।”

আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশে অস্থিরতা তৈরির সুযোগ দেবে না- তালেবানের এই কথায় পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আশ্বস্ত হতে চাইলেও ভরসা করতে পারছেন না সাবেক সেনা কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, “বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন, বিশেষ করে আ কায়দার সাথে তাদের পূর্ব সান্নিধ্যের ইতিহাস থেকে ধারণা করা যায় যে এই আশ্বাস অনেকটাই ভিত্তিহীন।

তালেবানের শীর্ষ নেতা মোল্লা ওমর ও আল কায়দার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন। দুজনের কেউ বেঁচে নেই।

“এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় জাতিসংঘের ২০২০ সালের একটি রিপোর্টে; যেখানে দেখা গেছে যে তালেবান ২০১৯ ও ২০২০ সালে বেশ কয়েকবার আল কায়দার সঙ্গে মিলিত হয়েছে তাদের প্রশিক্ষণ এবং অভিযান সংক্রান্ত পরিকল্পনার কাজে। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে নতুন করে আল কায়দার তৎপরতা লক্ষণীয় হয়েছে। ফলে তালেবানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতটুকু বাস্তবতার মুখ দেখবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।”

২০২০ সালে দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা চুক্তিতে তালেবান আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করে অন্য কোনো দেশে সন্ত্রাসী হামলার সুযোগ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।

তবে মনিরুজ্জামানের মতো তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমিরও।

তিনি বলেন, “আইএসের সঙ্গে তালেবানের কী সম্পর্ক হবে, আল কায়দার সঙ্গে কী সম্পর্ক হবে, তার উপরই এই অঞ্চলের অনেক কিছু নির্ভর করবে।”

ইতোমধ্যে কাবুল বিমানবন্দরে হামলার ঘটনায় দায় স্বীকার করে আইএসের বার্তা এসেছে, যে দলটি কয়েক বছর আগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে উৎখাত হয়ে এত দিন নীরব ছিল। 

আফগান পরিস্থিতির জটিলতা তুলে ধরে কূটনীতিক জমির বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, আফগানিস্তানে অনেকগুলো পরাশক্তি খেলছে। চীন ভাবছে উগ্রবাদীরা যদি তাদের উইঘুর মুসরিম অধ্যুষিত এলাকায় আসে তাহলে কী হবে?

“আবার চীন এবং রাশিয়া দুই দেশই আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। উত্তর আফগানিস্তানে চীন শত বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। সেখানে মাটিতে খনিজ রয়েছে, যা দিয়ে চিপ তৈরি করা যায়। এজন্য চীন যে কোনোভাবেই ওই অঞ্চলে দখল বজায় রাখতে চায়। আবার ইরান, উজবেকিস্তান, তার সঙ্গে কাজাখস্তান, তাজিকস্তান, কিরগিজস্তান এদের সবারই কিছু প্রভাব রয়েছে।”

চটজলদি সিদ্ধান্ত না নেওয়ার পরামর্শ

তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বলছে, তারা সব জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে সরকার গড়তে চায়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ইতোমধ্যে বলেছেন, সার্কভুক্ত দেশটিতে ‘জনগণের সরকার’ গঠন হলে সম্পর্ক স্থাপনে আপত্তি থাকবে না।

তালেবান নেতারা। ছবি: রয়টার্স

তবে আফগানিস্তানের বিষয়ে সরকারকে চটজলদি সিদ্ধান্ত না নিতে সরকারকে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

কূটনীতিক জমির মনে করেন, তালেবানের সরকারযাত্রা ততটা সহজ হবে না। কেননা সেখানে নানা জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ক্রমে বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, “এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশের উচিৎ হবে না স্বীকৃতি দেওয়ার। তাছাড়া তালেবানদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। যারা উত্তরের দিকের সেই পাখতুনের তালেবানের সঙ্গে সিন্ধ এবং বেলুচিস্তানের তালেবানের মতপার্থক্য রয়েছে। এজন্য এত সহজে সব বিষয় নির্ণয় করা যাবে না।”

তালেবানের নতুন সরকারের রূপ কেমন হবে, তা মধ্য সেপ্টেম্বরের আগে বোঝা যাবে না বলে মনে করেন জমির।

“তার জন্য অন্তত মধ্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নাইন ইলেভেনের (৯ সেপ্টেম্বর) পর হয়ত তালেবানের আসল চেহারা বেরোতে শুরু করবে।”

বিআইপিএসএস সভাপতি মুনিরুজ্জামান বলেন, “আমরা যেটা স্বাভাবিকভাবে গণতান্ত্রিক সরকারের শাসন বুঝি, সেটা তালেবানের পক্ষে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।

“তালেবানরা এখন এমন একটি সরকার গঠনের কথা বলছে, যাতে আফগানিস্তানের সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থিত আগের সরকারগুলোর প্রতিনিধিদের রাখতেও চাপ দিচ্ছে, যে কারণে পরবর্তী প্রশাসনেও আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও হাই কাউন্সিল ফর ন্যাশনল রিকনসিলিয়েশনের সাবেক প্রধান আব্দুল্লাহ আব্দুল্লাহকেও দেখা যেতে পারে।”

অন্যান্য সম্প্রদায়ের কিছুটা অন্তর্ভুক্তি থাকলেও সরকারে কর্তৃত্ব যে তালেবানের হাতেই থাকবে, তা স্পষ্ট।

মুনিরুজ্জামান বলেন, “তাদের সরকারের যে কঠোর পন্থা বজায় থাকবে, সেটাও কাবুলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য হাক্কানী গোষ্ঠীকে নিয়োগ দান থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

“যদিও তারা এবার নারীদের সমঅধিকারের কথা বলছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে এই আশ্বাস পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য তৈরিকৃত একটা ধূম্রজালও হতে পারে।”