ক্ষমতায় তালেবান: বাংলাদেশকে এগোতে হবে ‘রয়ে সয়ে’

আফগানিস্তানে উগ্রবাদী তালেবান সরকার গঠন করলেও সার্ক দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে অন্যদের দেখে তারপরই এগোনোর পক্ষপাতি বিশ্লেষকরা।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 August 2021, 02:52 AM
Updated : 25 August 2021, 02:52 AM

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলছেন, “পার্শ্ববর্তী দেশগুলো কী করছে, প্রথমে তা দেখা দরকার। তারপর আন্তর্জাতিক কমিউনিটি কী করছে, সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।”

বাংলাদেশের অন্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো কেমন সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখার পরামর্শ দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানে উৎখাত হওয়া তালেবান আবার ফিরে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

গোঁড়া ইসলামী দলটি দুই দশক পর গত ১৫ অগাস্ট আফগানিস্তানের রাজধানীর দখল নিয়েছে। তারা এখন সরকার গঠনের তোড়জোড় চালাচ্ছে।

আফগানিস্তানে নতুন সরকার গঠন হলে তাদের সঙ্গে শর্তসাপেক্ষে কাজ করার কথা ইতোমধ্যে বলছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তিনি বলেছেন, ”নতুন যে সরকারই আসুক, সেটা যদি জনগণের সরকার হয়, তাহলে আমরা তাকে গ্রহণ করব।”

তবে উগ্রবাদী তালেবানকে স্বীকৃতি না দিতে দেশের মধ্য থেকে সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।

তালেবানের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ওয়েট করতে পারি। যত ধীরগতি হয়, করা যায়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে দেখে বোঝা যাবে।

“যদি সবাই মোটামুটি রিকগনাইজ করে, বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় যেতেও পারে। কারণ তাদের তাৎক্ষণিকভাবে যেসব জিনিসের প্রয়োজন হবে, তা বাংলাদেশ থেকে যেতেও পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, তালেবান যেহেতু এখনও সরকার গঠন করেনি, তাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়ার সময় এখনও আসেনি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দুই জায়গায় আলাপ-আলোচনা চলছে। আমি মনে করি, এই আলাপ-আলোচনাটা চালু থাকা উচিৎ। এই আলাপ-আলোচনার পর, আমাদের অন্যান্য বন্ধু দেশ আছে, তারা কীভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, আমরাও সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহযোগী হতে পারি।”

তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, তালেবান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি চায় কি না, এখন তাদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তালেবানকে ‘সন্ত্রাসী’ গোষ্ঠী বলেই মনে করছেন এখনও।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি বলে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লিয়েন দুদিন আগেই জানান। তবে ইউরোপে কিছুটা নরম সুর দেখিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজন হলে তারা তালেবানের সঙ্গে কাজ করবেন।

চীন ও রাশিয়া তালেবানের সঙ্গে কাজ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে আফগানিস্তানে বিপুল বিনিয়োগ করা ভারত তালেবানের পুনরুত্থানে অস্বস্তিতে পড়েছে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ

সবাইকে নিয়ে চলতে যাওয়া তালেবানের সরকার কেমন হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে বলেছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।

তিনি বলেন, আফগানিস্তানে যেসব উপদল, গোত্র, নৃতাত্বিক গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের প্রতিনিধিত্ব সরকারে থাকছে কি না, তা দেখতে হবে।

“এখন পর্যন্ত তালেবানকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা প্রতিনিধিত্ব রাখবে, সে ধরনের একটা সরকার গঠন করলে বোঝা যাবে, তালেবান পরিবর্তন হয়েছে কি না?”

তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে তালেবান সরকার মাত্র তিনটি দেশের স্বীকৃতি পেলেও এবার পরিস্থিতি তেমন নয়।

“এবার একটা দিক আছে, আমেরিকা স্বীকার করেই নিয়েছে, দোহাতে তাদের সাথে চুক্তি করেছে, তালেবানের সাথে বসেছে, তার মানে হলো, সে তালেবানকে স্বীকারই করে ফেলেছে। স্বীকার করে নিলেও তাদের সব কিছু গ্রহণ করব, এটা নাও হতে পারে।”

আফগানিস্তানের অন্য নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে তালেবান নেতারা। শনিবারের বৈঠকের এই ছবি ফেইসবুকে দিয়েছেন আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ, যিনি নিজেও ওই বৈঠকে ছিলেন।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “এবার পাকিস্তান, ইরান, চীন, রাশিয়ার নাম শোনা যাচ্ছে, এমনকি তুরস্কও আলোচনা করছে। এই কয়টা দেশ এখনও দূতাবাস উঠিয়ে নেয়নি।

“পার্শ্ববর্তী দেশগুলো স্বীকৃতি দিলে বোঝা যাবে, কী হবে। যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে বলে ফেলেছে, তালেবানের সাথে প্রয়োজন হলে কাজ করতে পারি।”

তবে যেহেতু আফগানিস্তানে বাংলাদেশের বড় কোনো স্বার্থ নেই, তা সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।

“আমাদের অত তাড়াহুড়া নেই। কারণ আমাদের সে ধরনের স্টেক নেই। পাকিস্তান, ভারতের যেমন আছে। গত ২০ বছরে ভারতের অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগ নেই। কিছু ওষুধ থাকতে পারে। বড় ধরনের বাণিজ্য, ব্যবসা, ডায়াসপোরাও নেই। যেটা মধ্যপ্রাচ্যে আছে। সেজন্য আমরা ওয়েট করতে পারি।”

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন বলেন, “তালেবানদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে, আফগানিস্তান কোন দিকে যাবে, তাদের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কেমন হবে। তাদের ইতিবাচকতার উপর বাইরের ইতিবাচকতা তৈরি হবে। তারা যদি একলা চলো নীতিতে চলে, তার পরিণতি তাদের ভোগ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “তারা প্রাথমিকভাবে বলেছে ইসলামিক এমিরাত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামিক এমিরাত তো ইরানে আছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে আছে, তাতে তো অসুবিধা নাই।

“কিন্তু তারা যদি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যে সরকার চালিয়েছিল, কঠোর শরীয়াহ আইন করে, যেটা মধ্যযুগীয়, আধুনিক ব্যবস্থার সাথে যায় না, এই রকম যদি করে, তাহলে গ্রহণযোগ্যতাটা তারা পাবে না। তাহলে তারা স্বীকৃতিও পাবে না।”

তবে সরকার গঠনের জন্য অন্য আফগান নেতাদের সঙ্গে তালেবানের আলাপ-আলোচনাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন এই কূটনীতিক।

তার মতে, দুর্বল অর্থনীতির দেশ আফগানিস্তান এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তায় চলছিল। এখন অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

কাবুল জয়ের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তালেবান নেতারা।

দারিদ্র্য দূরীকরণে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আফগানিস্তানে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন হুমায়ুন কবির।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, “একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আফগানিস্তানের মানুষ কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সমর্থন করেছিল। কাজেই আমাদের দিক থেকে এটা মনে রেখে তাদের বিপদের সময় যাতে আমরা দাঁড়াতে পারি, ইতিবাচকভাবে তাহলে আমরা তাদের সে জায়গায় সহযোগিতা করতে পারি। এটা আমাদের একটা নৈতিক দায়িত্ব আছে।”

এদিকে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি সরকার পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এখন তালেবান প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছে, তা যদি রক্ষা করতে পারে, নিজেদের জনগণ ও বিদেশিদের যদি সুরক্ষা দিতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের সেখানে কাজ করার সুযোগ থাকবে। বাংলাদেশ উন্নয়নমূলক কাজ নিয়ে এগিয়ে যাবে।”

আফগানিস্তানে এখন বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। তা আবারও খোলার বিষয়ে প্রশ্ন করলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, “এ মুহূর্তে সেখানে দূতাবাস খোলার পরিকল্পনা নেই। এত দিন নিরাপত্তার কারণে বন্ধ ছিল। সেখানে নিরাপত্তা বাড়লে বিবেচনা করবে বাংলাদেশ।”

সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের অন্তত ২৭ জন বাংলাদেশি আটকা পড়ার তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ফেরানোর প্রক্রিয়া চলছে।

চরমপন্থার বিস্তার

সরকারের নীতির কারণে তালেবানের প্রভাবে দেশে উগ্রবাদী তৎপরতা নিয়ে শঙ্কার কারণ নেই বলে মনে করছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ ও রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “যে কোনো জঙ্গিবাদ, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হয়, রাষ্ট্রের কোনো গোষ্ঠী, রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হয়, প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে।

”আগে আমাদের রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা তো ছিলই। সেটা না বললে চলবে না। ওই পৃষ্ঠপোষকতা থাকার ফলে উৎসাহ পেয়েছে বলে বিস্তার হয়েছে। এখন কি কেউ ওই রকম মিছিল বের করবে?”

কাবুল দখলের পর রকেট লঞ্চার হাতে টহলে এক তালেবান যোদ্ধা। ছবি: রয়টার্স

গত শতকের ৭০-৮০ এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ করতে যেসব বাংলাদেশি গিয়েছিল, সেই ‘মুজাহিদ’দের হাত দিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন গড়ে ‍উঠেছিল।

সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়ার পর গৃহযুদ্ধের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করে নেয় গোঁড়া ইসলামী গোষ্ঠী তালেবান। পাঁচ বছর পর সেদেশে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়।

২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছিল তালেবান। তবে ২০ বছর বাদে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়ার শেষ পর্যায়ে এসে আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিল এই গোষ্ঠী।

বাংলাদেশি জঙ্গি মতাদর্শীদের আগে আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থানের পর গন্তব্য ঘুরে হয়ে যায় সিরিয়া-ইরাক। কিন্তু আইএসের পতনের কয়েক বছর পর তালেবানের পুনরুত্থানে আগের চিত্রই ফিরে আসার খবর মিলছে।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “সেটাতে তো আমাদের জিরো টলারেন্স পলিসি আছে। এখন বাংলাদেশের মানুষও এটা পছন্দ করে না।

“কাজে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা কাজ করি, আঞ্চলিক বা বৈশ্বিকভাবে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমরা যে কাজ করে যাচ্ছি, তাতে হয়ত আফগানিস্তান নতুন এলিমেন্ট হিসাবে যুক্ত হবে। সে ধরনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।”

ডিএমপি কমিশনারের ’তথ্যপ্রমাণহীন’ বক্তব্যে ‘ইমেজ সঙ্কট’ তৈরি হতে পারে মন্তব্য করে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান ঠিকই আছে। তবে পুলিশ কমিশনার যে বক্তব্য দিয়েছেন, ১০ জন না কি বিষয়ে… সেটা ঠিক হয়নি।”

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, তালেবানে যোগ দিতে বাংলাদেশের ‘কিছু মানুষ’ আফগানিস্তানে পৌঁছার চেষ্টা করছে, কিছু ভারতে গ্রেপ্তারও হয়েছে।

অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, “এই যে কথাবার্তা বলে, একটা ইমেজ সঙ্কট হয়। মিডিয়া কাভার করবে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যাবে, এর ফলে মনে হবে, বাংলাদেশ বুঝি আগের মতো ওদিকে যাচ্ছে।

“কিন্তু আজকের বাংলাদেশ আর ২০ বছর আগের বাংলাদেশ তো আলাদা। কেউ যদি বলে, তাহলে তার সঙ্গে যেন তথ্যপ্রমাণ থাকে।”