তালেবানের পুনরুত্থান: বাংলাদেশের জন্য কতটা শঙ্কার?

বাংলাদেশে জঙ্গিত্বের উৎসভূমি আফগানিস্তানে তালেবানের পুনরুত্থানে দেশে নতুন সঙ্কটের আশঙ্কা জেগে ‍উঠলেও পুলিশের মধ্যেই এমন মত পাওয়া গেছে যে এতে বড় শঙ্কার কোনো কারণ নেই।

লিটন হায়দারও গোলাম মর্তুজাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2021, 03:34 AM
Updated : 18 August 2021, 03:34 AM

তালেবানে যোগ দিতে কিছু বাংলাদেশির আফগানিস্তান যাওয়ার খবর নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের কাছে উদ্বেগের মনে হলেও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান তেমন ভাবনার কিছু দেখছেন না।

আফগান তালেবান অন্য কোনো দেশে তার সংগঠন বিস্তৃত করছে না, তাদের এই বক্তব্যে আস্থা রেখে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে কেউ তাদের দলে যোগ দিতে পেরেছে, এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।

তবে বাংলাদেশে তালেবানের সমর্থক থাকতে পারে বলে স্বীকার করে আসাদুজ্জামান বলেন, “তবে কেউ এনিয়ে কিছু করতে পারবে বা নাশকতা করতে পারবে বলে মনে করি না। আমরা সতর্ক আছি। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত আছি।”

গত শতকের ৭০-৮০ এর দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধ করতে যেসব বাংলাদেশি গিয়েছিল, তাদের হাত দিয়েই বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠন গড়ে ‍উঠেছিল। হরকাতুল জিহাদসহ জেএমবির নেতাদের সবার আফগান যোগের বিষয়টি পরে প্রকাশ পায়।

সোভিয়েত সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়ার পর গৃহযুদ্ধের মধ্যে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখল করে নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান। গোঁড়া এই ইসলামী দলটি পাঁচ বছর পর সেদেশে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর অভিযানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়।

২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দিয়েই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছিল তালেবান। তবে ২০ বছর বাদে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যদের আফগানিস্তান ছাড়ার শেষ পর্যায়ে এসে আবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল নিল এই গোষ্ঠী।

বাংলাদেশি জঙ্গি মতাদর্শীদের আগে আফগানিস্তানে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও মধ্যপ্রাচ্যে আইএসের উত্থানের পর গন্তব্য ঘুরে হয়ে যায় সিরিয়া-ইরাক। কিন্তু আইএসের পতনের কয়েক বছর পর তালেবানের পুনরুত্থানে আগের চিত্রই ফিরে আসার খবর মিলছে।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, তালেবানে যোগ দিতে বাংলাদেশের ‘কিছু মানুষ’ আফগানিস্তানে পৌঁছার চেষ্টা করছে, কিছু ভারতে গ্রেপ্তারও হয়েছে।

মো. আসাদুজ্জামান।

তবে কাউন্টার টেররিজমের প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, যারা ঘর ছেড়েছে, তারা আফগানিস্তান পৌঁছতে পেরেছে কি না, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।

“তারা মিসিং, ওই পর্যন্ত পৌঁছছে কি না, নিশ্চিত না। তবে তারা তাদের অন্য সহযোগীদের উদ্ধুদ্ধ করেছিল।

“তবে বাংলাদেশ কেন, কোনো বিদেশিই তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি। দুই-একজন যদি যেয়েও থাকে, সেটা তার ব্যক্তিগত বা ওই পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।”

তালেবানের যে কোনো বিদেশি শাখা নেই, সেটা সংগঠনটির বক্তব্যেই পাওয়ার কথা জানান সিটিটিসি কর্মকর্তা।

“তালেবানরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলসহ সামগ্রিক বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা এটা নিশ্চিত করে বলেছে আন্তর্জাতিক বা দেশের কোনো সংগঠনের সাথে তাদের যোগসূত্র নেই। আফগানিস্তানের বাইরে তাদের অনুমোদিত কোনো সংগঠনও নাই।”

আফগানিস্তানের পাশাপাশি পাকিস্তানে তালেবানের কর্মকাণ্ড চললেও দলটিতে বিদেশি যোদ্ধা নেই বলে মেনে নিচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা এম সাখাওয়াত হোসেনও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেউ আফগানিস্তানে গেছে বললেই আমরা ধরে নেই যে তিনি তালেবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন। কিন্তু এই বিষয়টা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে তালেবান হচ্ছে পশতুভাষী খাঁটি আফাগানদের সংগঠন। তালেবানরা কোনো বিদেশি যোদ্ধাকে আমন্ত্রণ জানায় না।

“তালেবানের সঙ্গে আফগানদের বাইরে যারা রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকার, তবে তারাও পশতুভাষী।”

আফগান তালেবান যোদ্ধারা। ছবি: রয়টার্স

তাহলে বিদেশিরা যাচ্ছে কোথায়- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “আশির দশকে সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধের সময় বাংলাদেশসহ যে বিদেশি যোদ্ধারা সেখানে গিয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে। ওসামা ও তালেবান এক নয়।”

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) ইনস্টিটিউট অব টেররিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তালেবানের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে যে তাদের মধ্যে কোনো বিদেশি যোদ্ধা নেই। তবে তাদের এই কথাটি পুরোপুরি আমলে নেওয়ার মতো নয়।”

কেন নয়- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আফগানিস্তানে অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর উপস্থিতিও রয়েছে। যেমন আইসিস খোরাসান, এর পাশাপাশি আল কায়েদারও পুনরুত্থানের একটা সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে তথ্য ও উপাত্ত কিছুটা অপ্রতুল।

“তবুও ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারে, আফগানিস্তানে অন্যান্য যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী বিশেষ করে আল কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোতে যোগদানের জন্য তরুণেরা সেখানে যেতে পারেন।”

এম সাখাওয়াত হোসেন।

বিষয়টিকে ‘অ্যালার্মিং’ বলছেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, “দেশ থেকে আফগানিস্তানে যাওয়ার ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তাহলে সেটা খুবই অ্যালার্মিং। তবে এটা বলা যায়, বিদেশি মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে নয়, আইএস বা অন্য গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হতে সেখানে যাচ্ছে।”

তালেবানের উত্থানের বিষয়টি যে উদ্বেগের, তা ফুটে ওঠে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শফিকুলের কথায়।

“আফগানিস্তানফেরত বাংলাদেশিরাই পরে হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ও জেএমবিসহ একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করেছিল। এসব জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল তারা কাশ্মিরে গিয়ে যুদ্ধ করবে। তারা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে জয় লাভ করেছে, তারা কাশ্মিরে গিয়ে যুদ্ধ করেও জয়লাভ করবে বলে এমন ধারণা ছিল। এরপর নানাবিধ কারণে তারা কাশ্মিরে সফল হতে পারেনি। পরে বাংলাদেশেই তারা খিলাফত কায়েমের জন্য আন্দোলন শুরু করে।”

তালেবানের পুনরুত্থান যে জঙ্গিদের উৎসাহিত করতে পারে, সেই ভাবনাও করছেন শফিকুল।

শফিকুল ইসলাম।

“তালেবানরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নেওয়ার পরই ঘোষণা করবে, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তারা আরও বলবে, ‘আমেরিকাকে যুদ্ধে পরাজিত করে আফগানিস্তানকে স্বাধীন করেছি’। এর প্রেক্ষাপটে যুবকদের ভেতর (যারা জিহাদ করতে চায়) উৎসাহ তৈরি হবে। এই ঢেউ আমাদের উপমহাদেশসহ সব দেশেই লাগবে।”

তবে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, আফগানফেরত মুজাহিদদের নিয়ে গঠিত দল হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে, তাদের কোনো তৎপরতা নেই।

কিন্তু তালেবানের বিজয়ে সোশাল মিডিয়ায় কারও কারও যে উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “তারা হয়তো আদর্শের কারণে সমর্থন করতে পারে, অনুসারীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস আসতেও পারে। তার মানে এই নয় যে তাদের কিছু করার সক্ষমতা আছে।”

আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে অন্য দেশের শান্তি এবং স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না দেওয়ার যে ঘোষণা তালেবান দিয়েছে, তাতেও গুরুত্ব দিচ্ছেন আসাদুজ্জামান।

“জঙ্গি সংগঠনই হোক আর সন্ত্রাসী সংগঠনই হোক, কারও সাথে তাদের (তালেবান) যোগাযোগ নেই, এ ব্যাপারে তাদের (তালেবানদের) অবস্থান তারা স্পষ্ট জানিয়েছে।”

এরপরও যারা আফগানিস্তানে যেতে চাইবে, তাদের নিরুৎসাহিত করতে তিনি বলেন, “ইতিপূর্বে যারা গিয়েছিল, তাদের পরিণতি কী হয়েছিল, এটা সবাই জানে। তাদের পরিণতি তো সুখকর না। আমরা এ বিষয়টিও মানুষকে জানাতে সক্ষম হয়েছি।”

তিনি বলেন, আফগানিস্তান যেতে অনলাইনে যারা আহ্বান জানাচ্ছে তাতে ‘রেসপন্স খুবই কম’। কারণ বাংলাদেশের মানুষ কখনই জঙ্গিবাদকে পছন্দ করে না।

এই ধরনের প্রচারকারীদের শনাক্ত করতে সজাগ রয়েছেন জানিয়ে আসাদুজ্জামান বলেন, “আমাদের পেট্রোলিং আছে, এর মাধ্যমে তাদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব। যারা পোস্ট দিয়েছে, তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।”

জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।