মহামারী নিয়ন্ত্রণে এলেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কমিশন: আইনমন্ত্রী

দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2021, 01:42 PM
Updated : 12 August 2021, 01:42 PM

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪৬তম বার্ষিকী সামনে রেখে বৃহস্পতিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ কথা জানান তিনি।

আইনমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর খুনি যাদের সাজা হয়েছে, কেবল তারা এককভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তা নয়, এর পেছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে। ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে তাদের নাম জনসম্মুখে প্রকাশের সিদ্ধান্ত সরকার ইতোমধ্যে নিয়েছে।

”এই কমিশনের রূপরেখা কী হবে? এই কমিশনের কার্যাবলি কী হবে এবং এই কমিশনটা কাদের দ্বারা গঠিত হবে। এই জিনিসগুলি করোনাভাইরাসের প্রকোপটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা দেখতে পাবেন।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

একদল সেনা কর্মকর্তা এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিলেও এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বরাবরই বলে আসছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল। খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম তখন ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক থাকা অবস্থায় দেশের বাইরে মারা যান বলে খবর আসে।

বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, এ কে বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যায়।

এরপর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ওই পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয় ঢাকার কারাগারে। বাকি ছয়জন পলাতক থেকে যান।

তার প্রায় ১০ বছর পর গত বছরের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক ছয়জনের একজন ৭২ বছর বয়সী মাজেদকে ঢাকার গাবতলী থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।

পলাতক মাজেদের আপিলের সুযোগ ছিল না। রাষ্ট্রপতির কাছে তিনি প্রাণভিক্ষার চেয়ে আবেদন করেছিলেন, যা নাকচ হয়ে যাওয়ার পর কেরানীগঞ্জের কারাগারে ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রসঙ্গ টেনে মামলা পরিচালনায় যুক্ত আনিসুল হক বলেন, “প্রথমে আমরা যেটা করেছিলাম, সেটা হচ্ছে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলা শেষ করা এবং এই যে পলাতক আসামি যারা আছেন, তাদের রায় কার্যকর করার জন্য তাদেরকে ফিরিয়ে আনা।

”তারপর যেটা হয়, সেটা হচ্ছে আলাপ-আলোচনার মধ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে আসে এবং এটা আমাদের জানা থাকলেও জনসম্মুখে স্পষ্টতার জন্য… শুধু তারা এককভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত- তা নয়, এটার পেছনে একটা ষড়যন্ত্র আছে। এবং সে ষড়যন্ত্রকারী কারা, তাদেরকে অন্ততপক্ষে চিহ্নিত করে সারাদেশের মানুষের কাছে তাদের নামটা অন্ততপক্ষে জানিয়ে দেওয়া।”

চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া হিসাবে তদন্ত কমিশন করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে গত মার্চ মাসের ৮ তারিখ ২০২০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কিন্তু দেশে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা ছিল না। সেটা কেবল বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে।

”সে কারণে আমরা যে রূপরেখাটি তৈরি করেছি, সেটা কিন্তু এখনো জনসম্মুখে এবং সেটার ব্যাপারে আমরা এখনো সিদ্ধান্ত দিতে পারিনি।”

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রধান কৌঁসুলি আনিসুল হক বলেন, “এটা দিনের আলোর মতন সত্য যে, জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। কিন্তু এখন আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, তাহলে যখন এই মামলার তদন্ত হয় তখন তাকে আসামি করা হয় নাই কেন?

”জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে হত্যাকৃত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি যখন মৃত, তাকে আর আসামি করার সুযোগ নাই। দেখেন, আমাদের আইনে মরণোত্তর সাজা দেওয়ার কোনো বিধান নাই। সেজন্য আইনের বাইরে গিয়ে আমরা শুধু তামাশা করার জন্য একজনকে সাজা দেব না।”

এই হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান কীভাবে জড়িত এবং সেটার সাক্ষ্যপ্রমাণ জনসম্মুখে উপস্থাপন করেই তদন্ত কমিশনের কাজ হবে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।

পলাতক খুনীদের ফেরানোর প্রসঙ্গ

বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফেরানোর প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “যারা সর্বোচ্চ আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত, তাদের (মধ্যে) যাদের ব্যাপারে এই রায় এখনো কার্যকর করা যায়নি তারা পলাতক থাকার কারণে, এবং দুজন দুটি দেশে থাকার কারণে, তাদেরকে ফিরিয়ে এনে এই রায় কার্যকর করার ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর।

”সরকার নয়, আওয়ামী লীগ যতক্ষণ থাকবে, আমার মনে হয় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী একজন থাকলেও তাদেরকে (খুনি) ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের যে চলমান প্রক্রিয়া, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য সেটা অব্যাহত আছে।”

তবে এখন এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করলে সেই প্রক্রিয়া ‘ব্যাহত হাতে পারে’ মন্তব্য করে আর কোনো তথ্য দেওয়া থেকে আইনমন্ত্রী বিরত থাকেন।

তিনি বলেন, “আমি শুধু আপনাদের এ কথাই বলব, এই ব্যাপারে কোনো শিথিলতা নাই এবং তাদেরকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব, চালিয়ে যাচ্ছি।”

আদালতের রায় মাথায় নিয়ে যে পাঁচজন এখনও পলাতক, তারা হলেন: আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী।

এর মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় অবস্থানের খবর সবার জানা। তাদের ফেরানোর চেষ্টা চললেও তার কোনো অগ্রগতি নেই।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, “এই যে প্রক্রিয়াটা, যে প্রক্রিয়া আমরা চালাচ্ছি, সেটা সম্বন্ধে আলাপ করাটাও কিন্তু তাদেরকে ফিরিয়ে আনার যে ব্যাপারটা, সেটাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করতে পারে। সেজন্য আমি আপনাদের কথার জবাব দেব না।”