চার সাইকেল কেমোথেরাপি নেওয়ার পর এখন কিছুটা সুস্থ ৬০ বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী। কিন্তু চিকিৎসক বলে দিয়েছেন, এই অবস্থায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে ‘মুশকিল’ হবে।
তাই কোভিড-১৯ টিকা পেতে মরিয়া ওয়ালিদ মঙ্গলবার রাত ১০টায় এসে মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে লাইনে দাঁড়িয়েছেন।
সপ্তাহব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচিতে এই বিদ্যালয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া হচ্ছে।
বুধবার সকালে যাতে টিকা নিতে পারেন এজন্য এক দিন আগেই ওয়ালিদের এই লাইনে দাঁড়ানো। তবে রাত ১০টায় এসেও তালিকায় আরও দুজনের পরে নাম উঠেছে তার। অর্থাৎ তার সামনে আরও দুজন রয়েছেন।
পরের দিন সকালে টিকা নিতে আগের রাত ১০টায় কেন- প্রশ্ন করলে জানা যায়, একদিন আগে রাত আড়াইটায় দাঁড়িয়েও টিকা পাননি ওয়ালিদ।
“এজন্য আজ রাতের খাওয়া সেরেই চলে এসেছি,” বলেন তিনি।
টিকার ওই তালিকায় এক নম্বর নামটি শওকত আলীর। তার বয়সও ষাটের বেশি। ছেলে মো. নাসিমকে সঙ্গে নিয়ে একটা ব্যাগে খাবার, পানি, ছাতা আর পুরনো সংবাদপত্র হাতে তিনি সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়েই এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
কয়েক ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে যখন শওকত আলীর সঙ্গে কথা হল, তখন ক্লান্তিতে দাঁড়াতে পারছিলেন না তিনি। অন্ধকার ফুটপাথের একপাশে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন। এসময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়।
শওকত আলী বলেন, “কে রেজিস্ট্রেশন কইরা দিব। এইখানে কার্ড নিয়া আসলে নগদে টিকা দেয়, এজন্য একটু কষ্ট হইলেও বইসা রইছি।”
শওকত জানান, সোমবার রাত থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে মঙ্গলবার টিকা নিয়ে গেছেন তার স্ত্রী।
এত রাতেও স্কুলের সামনে চটপটি বিক্রি করছিলেন মো. খোকন। টিকার জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের শলাপরামর্শও দিচ্ছিলেন তিনি।
খোকন বলেন, “টিকা শুরু হওয়ার পর থেকেই এখানে এই অবস্থা। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে লোকজন লাইনে দাঁড়ান। লাইনে দাঁড়ানো বেশিরভাগই বয়স্ক লোক। মহিলারাও আসে।”
তবে নারীদের ক্ষেত্রে সন্ধ্যা থেকে পরিবারের কোনো তরুণ সদস্য লাইনে থাকেন। ভোররাতের দিকে নারীরা এসে লাইনে দাঁড়ান।
৩১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম সেন্টুর কর্মী পরিচয় দিয়ে সেখানে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের তালিকার বিষয়টি দেখভাল করছিলেন মাইনুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি।
তিনি বলেন, “রাত থেকেই লোকজন আসা শুরু করে। ভোরের দিকে লম্বা লাইন পড়ে যায়। তিন হাজারের কম মানুষ একদিনও হয়নি।”
তবে টিকা আসে চাহিদার ১০ ভাগের এক ভাগ। তাই দিনের বেলায় গুণে গুণে সাড়ে তিনশ জনকে টিকা কেন্দ্রে ঢোকানো হয়।
মাঈনুদ্দীন জানান, কেন্দ্রে ঢোকানোর পর কাউন্সিলর শফিকুলের পক্ষ থেকে টিকাগ্রহীতাদের কেক, ফলের রস খেতে দেওয়া হয়।
তার আগ পর্যন্ত প্রায় না খেয়েই দাঁড়িয়ে থাকেন টিকা নিতে আসা ব্যক্তিরা। বয়স্কদের অনেকে অবশ্য বাড়ি থেকে খাবার বেঁধে নিয়ে আসেন।
রাত সাড়ে পৌনে ১১টার দিকে ওয়ালিউল্লাহ নামে এক তরুণ জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে লাইনে দাঁড়ান। টিকার অপেক্ষমানদের তালিকায় নাম তোলার জন্য মাইনুদ্দীনকে অনুরোধ জানান।
তবে জাতীয় পরিচয়পত্রটি হাতে নিয়ে মাইনুদ্দীন জানিয়ে দেন, ওয়ালিউল্লাহ ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এখানে শুধু ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের টিকা দেওয়া হবে।
মাইনুদ্দীন বলেন, প্রতিদিনই অন্য ওয়ার্ডের লোকজন রাত থেকেই লাইনে দাঁড়ায়। সঙ্গত কারণেই দিনের বেলায় আর টিকা নিতে পারে না। এসব দেখভালের জন্যই তাকে এখানে থাকতে বলেছেন কাউন্সিলর।
যোগাযোগ করা হলে কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম বলেন, “এখানে টিকা দেওয়া হয় সাড়ে তিনশ’ লোককে। কিন্তু ভিড় করেন অনেক বেশি মানুষ।”
গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে টিকাদান শুরুর পর নিবন্ধনের মাধ্যমে শুধু টিকা দেওয়া হচ্ছিল। তাতে নিবন্ধনের পর টিকাগ্রহীতার মোবাইল ফোনে এসএমএস যায়, তাতে টিকাগ্রহণের তারিখ ও কেন্দ্রে উল্লেখ করা থাকে।
কিন্তু গত ৭ অগাস্ট ব্যাপকভিত্তিক টিকাদান শুরুর পর নিবন্ধন ছাড়াই টিকা নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বিভিন্ন কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলাও দেখা দিয়েছে।
চাহিদার তুলনায় টিকা কম থাকায় অনেককে টিকা না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে।