পরীমনি মাদক নিলে রিহ্যাবে পাঠান, রিমান্ডে কেন: শুনানিতে আইনজীবী

চিত্রনায়িকা পরীমনিকে মাদক আইনের মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার বিরোধিতা করে তার আইনজীবী বলেছেন, সত্যিই মাদক নিয়ে থাকলে তাকে পুলিশ হেফাজতে না পাঠিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2021, 01:51 PM
Updated : 10 August 2021, 02:20 PM

বনানী থানার মাদক আইনের মামলায় পরীমনিকে ফের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মঙ্গলবার সিআইডির করা আবেদনের ওপর শুনানিতে এমন যুক্তি দেন এই চিত্রনায়িকার আইনজীবী আইনজীবী মো. মজিবুর রহমান।

সিএইডির পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি শেষে মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস দুই দিনের হেফাজতে নিয়ে পরীমনিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। এ মামলায় আগেও চারদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।

চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজকে মাদক আইনের মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে নেওয়া হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শুনানি শেষে এজলাস থেকে বেরিয়ে লিফটে ওঠার আগে ভিড় করে থাকা উৎসুক জনতাকে উদ্দেশ্য করে পরীমনি বলেন, “আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে।”

গত ৪ অগাস্ট পরীমনির সঙ্গে গ্রেপ্তার তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুকেও এ মামলায় নতুন করে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।

আর পরীমনির বাসায় অভিযানের পর একই রাতে গ্রেপ্তার প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ এবং তার ব্যবস্থাপক সবুজ আলীকে মাদক ও পর্নগ্রাফি আইনের দুই মামলায় মোট ছয়দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছে একই আদালত।

বনানী থানার মাদক আইনের মামলায় তাদের দুজনকে চার দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদের পর মঙ্গলবার আদালতে হাজির করে ওই মামলাতেই আরও পাঁচদিন করে এবং পর্নগ্রাফি আইনের মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ডে চেয়েছিল পুলিশ।

পরীমনি ও দীপুর মামলায় রিমান্ড আবেদনের ওপর রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ঢাকা মহানগর জজ আদালতের পিপি আব্দুল্লাহ আবু ও ও সাজ্জাদুল হক শিহাব।

তাদের যুক্তি উপস্থাপন শেষে পরীমনির আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, মামলার কোনো কাগজে বলা হয়নি যে পরীমনি ‘মাদক ব্যবসায়ী’।

“আদালতের কাছে মিথ্যা কথা বলব না। যদি উনি মাদক সেবন করেই থাকেন, এবং মাদকের আইটেম যদি তার ঘরে পাওয়াও যায়, তাহলে আইন অনুযায়ী তাকে রিহ্যাবিলিটেশনে পাঠানো হোক, রিমান্ড কেন?

“ইওর অনার, আপনি জানেন যে অসুস্থ ব্যক্তি, নারী ও শিশুরা জামিন ও রিমান্ডের ব্যাপারে অনেক সুযোগ পেয়ে থাকেন। পরীমনি তো কোনো ক্যাডার নন। আমরা মামলার কোনো রিমান্ড আবেদন দেখতেই পারিনি। পুলিশ এবং রাষ্ট্রপক্ষ নথির ধারে কাছে যেতে দেয়নি।”

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আবু তখন বলেন, “আমাদের কাছে তো ফরোয়ার্ডিং ছিল, দেখলেন না কেন?”

পরীমনিকে রিমান্ডে পাঠানোর বিরোধিতা করে আইনজীবী মজিবুর রহমান বলেন, “ফোর্বস ম্যাগাজিনে শত শত চিত্রনায়িকার ছবি এবং জীবনী ছাপা হয়েছে, সেখানে পরীমনির নাম আছে। তাকে রিমান্ডে পাঠিয়ে দেশের বিভিন্ন পারপাস সার্ভ করতে হবে-এমনটি কি হওয়া উচিত? এটি যৌক্তিক? এটি কি নৈতিক?”

বিভিন্ন পার্টি আর মাদক চক্রে পরীমনির সংশ্লিষ্টতার যেসব কথা এখন আসছে, সেই প্রসঙ্গ ধরে এই আইনজীবী বলেন, “ঢাকার নবাব বাড়িতে আগে বাইজি রাখা হত, সেখানে মানুষজনকে সুস্থ বিনোদন তারা দিতেন। যদি ইতিহাসে যাই, তাহলে দেখা যায় সেসব বাইজিদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা হত না।

চিত্রনায়িকা পরীমনিকে মাদক আইনের মামলায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মঙ্গলবার দুপুরে আদালতে নেওয়া হয়। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

“বাইজি নায়িকা ললিতা রায় সিনেমা করেছিলেন ‘দ্য লাস্ট কিস’। ঢাকার নবাব বাড়ির অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিল। সেখানে দৃশ্যে দৃশ্যে মদ ছিল, সেখানে তো মামলা হয়নি। তাদেরকে মানুষ ভালোবেসেছে।”

রাজ ও সবুজ আলীর বিরুদ্ধে অন্য দুই মামলায় রিমান্ড আবেদনের শুনানিতে আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “প্রযোজক রাজ মেয়েদের বাসায় নিয়ে অশ্লীল কাজ করাতেন, সেগুলোর ভিডিও ক্লিপ ধারণ করতেন। যা সমাজের ঘৃণিত একটি কাজ। আসামি রাজের অপকর্মের সঙ্গে আরও কারা জড়িত আছেন, কেন ভিডিও ক্লিপ ধারণ করতেন, বিষয়গুলোর সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে তাকে রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন।”

অন্যদিকে রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন আবেদন করেন আইনজীবী সিকদার মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান হিমেল।

তিনি বলেন, “এজাহার অনুযায়ী মাদক মামলায় তার বাসা থেকে বিদেশি মদ, ইয়াবাসহ যা উদ্ধার করার, সবই উদ্ধার করা হয়েছে। তাহলে তাকে বারবার রিমান্ডে নিয়ে কেন হয়রানি করা হচ্ছে?”

আর পর্নগ্রাফি আইনের মামলার বিষয়ে আইনজীবী হিমেল বলেন,  “কিছু মালামাল জব্দ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা আবেদনে বলেছেন, জব্দ করা মালামাল আরও কী কাজে ব্যবহার করা হত, সেটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। তার মানে এগুলো অন্য কাজে লাগানো যায়। মূলত এগুলো পর্নগ্রাফির কাজে ব্যবহার করার কোনো মালামাল নয়। স্যার পর্নোগ্রাফি আইনে কী আছে আপনি সেটা দেখেন। আসামিকে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”

শুনানি শেষে বিচারক চার আসামির সবাইকেই বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন।

নড়াইলের মেয়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি ঢাকার চলচ্চিত্রে পরীমনি নামে অভিষিক্ত হন ২০১৫ সালে। সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তুলে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন তিনি।

আর রাজ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার। তিনি অভিনয়ও করেন।

‘ডিজে পার্টি’ আয়োজনের আড়ালে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৩ অগাস্ট ঢাকায় শরিফুল হাসান (মিশু হাসান) ও মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার পরদিন র‌্যাব যায় পরীমনির বনানীর বাসায়।

কয়েক ঘণ্টা অভিযান শেষে পরীমনি এবং তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুকে আটক করে নিয়ে যায় র‌্যাব। এরপর অভিযান চলে বনানীতে চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজের বাড়িতে। সেখান থেকে রাজ এবং তার ব্যবস্থাপক সবুজ আলীকে র‌্যাব আটক করে।

৫ অগাস্ট উত্তরায় র‌্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, পরীমনি ও রাজের বাড়িতে ‘মদ ও মাদকদ্রব্য’ পেয়েছেন তারা। পরীমনির একটি মদের লাইসেন্স পাওয়া গেলেও তার মেয়াদ ছিল না। এছাড়া রাজকে গ্রেপ্তারের সময় কম্পিউটারে 'পার্ন কনটেন্ট' পাওয়া গেছে।

মিশু ও জিসানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরীমনি ও রাজের বাড়িতে অভিযান চালানো হয় বলে কমান্ডার আল মঈন সেদিন জানান।

এরপর চারজনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, বনানী থানায় দায়ের করা হয় মাদক আইনে দুটি মামলা। এছাড়া রাজ ও সজুজের বিরুদ্ধে পর্নগ্রাফি আইনে আরেকটি মামলা করা হয়।

র‌্যাবের করা জব্দ তালিকায় পরীমনির বাসা থেকে ‘বিপুল পরিমাণ মদ এবং আইস ও এলএসডির মতো মাদকদ্রব্য’ উদ্ধারের কথা বলা হয়। আর রাজের ফ্ল্যাট থেকে মদ ও ইয়াবার সঙ্গে ‘সেক্স টয়’ এবং একটি সাউন্ড বক্স জব্দ করার কথা বলা হয়।

৫ অগাস্ট সন্ধ্যায় চারজনকে আদালতে তোলা হলে মাদক আইনের দুই মামলায় চারজনকে চার দিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন ঢাকার মহানগর হাকিম মো. মামুনুর রশিদ।

পরে মাদক আইনের দুই মামলার তদন্তভার সিআইডির হাতে যায়। তবে পর্নগ্রাফি আইনের মামলা এখনও বনানী থানা পুলিশই তদন্ত করছে।