বুধবার রাতে বাসা থেকে আটকের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পরীমনিকে পুলিশে হস্তান্তর করে র্যাব। তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় করা হয় মাদকদ্রব্য আইনে মামলা।
এরপর রাতেই পরীমনিকে ঢাকার আদালতে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তাকে সাত দিন হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বনানী থানার পরিদর্শক সোহেল রানা।
শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. মামুনুর রশিদ চার দিন রিমান্ডের আদেশ দেন। অর্থাৎ পুলিশ এই কয়দিন এই চিত্রনায়িকাকে তাদের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।
পরীমনির পক্ষে তার আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল করে জামিনের আবেদন জানালেও তা নাকচ করে দেন বিচারক।
পরীমনির সঙ্গে মামলার আসামি তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম দীপুকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের হেফাজতে পেয়েছে পুলিশ।
গ্রেপ্তার চলচ্চিত্র প্রযোজক নজরুল ইসলাম রাজ এবং তার ব্যবস্থাপক সবুজ আলীকেও র্যাবের করা আলাদা মাদক মামলায় হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
তাদেরও চার দিন রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ। ওই মামলাটিও তদন্ত করছেন পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা।
বুধবার রাতে ঢাকার বনানীতে পরীমনির বাড়িতে প্রথমে অভিযান চালিয়ে রাতে তাকে ও দীপুকে আটক করে নিয়ে যায় র্যাব।
এরপর অভিযান চলে বনানীতে রাজের বাড়িতে; সেখান থেকে তাকে ও সবুজকেও আটক করা হয়।
তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাদের র্যাব সদর দপ্তরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
প্রায় ২৪ ঘণ্টা নিজেদের হেফাজতে রাখার পর বৃহস্পতিবার বিকালে পরীমনিদের আটকের বিষয়ে উত্তরায় র্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাহিনীর মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, পরীমনি ও রাজের বাড়িতে মাদকদ্রব্য পেয়েছেন তারা। এজন্য চারজনের বিরুদ্ধেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হবে।
রাজের বিরুদ্ধে পর্নগ্রাফি আইনে মামলা হবে বলেও সংবাদ সম্মেলনে জানান র্যাব মুখপাত্র।
তাদের পুলিশে হস্তান্তরের সময় মাদক আইনেই কেবল দুটি মামলা হয় বলে জানান বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া।
তবে গভীর রাতে রাতে রাজসহ দুজনের বিরুদ্ধে পর্নগ্রাফি আইনে আরেকটি মামলা হয় বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা নূরে আযম।
জনাকীর্ণ আদালতে হট্টগোল
পরীমনিকে রাত সাড়ে ৮টায় ঢাকার আদালতে এজলাসের কাঠগড়ায় তোলা হয়। মহামারী নিয়ন্ত্রণের বিধি-নিষেধের মধ্যেও আইনজীবী, সাংবাদিক, পুলিশে জনাকীর্ণ ছিল আদালত।
পরীমনির সঙ্গে রাজ, সবুজ ও দীপুকেও তোলা হয় কাঠগড়ায়।
দুই মামলার শুনানি চলে মাত্র আধা ঘণ্টা। কিন্তু শুনানির আগে চার আসামির ওকালতনামায় স্বাক্ষর নিয়ে আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোলে কেটে যায় আরও আধা ঘণ্টা।
বিচারক মামুনুর রশিদ এজলাসে ওঠার আগে তার কর্মচারী খাসকামরা থেকে এজলাসের ডায়াসে এসে বলেন, ওকালতনামায় যারা স্বাক্ষর করবেন, কেবল তারাই এজলাসে থাকতে পারবেন।
এ সময় এজলাসে উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারাও অন্য আইনজীবীদের চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
চার আসামিকে এজলাসে তোলা হলে পুলিশি বেষ্টনির মধ্যেই পরীমনিকে তার একজন আইনজীবী আবেগে জড়িয়ে ধরেন। এসময় এই চিত্রতারকার চোখে ছিল জল। ওই আইনজীবীকে পরীমনি ‘নিলয়’ বলে সম্বোধন করেন।
পরীমনির পক্ষে আইনজীবী নিলাঞ্জনা রিফাত সুরভী ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিতে চাইলে অন্যরা আটকে দেন।
এসময় বিচারক মামুনুর রশীদ ওকালতনামায় স্বাক্ষর করা আইনজীবীদের ডেকে অন্যদের চলে যেতে বলেন।
প্রথমে পরীমনি ও দীপুর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি হয়। এরপরে ওঠে রাজ ও সবুজের বিরুদ্ধে মামলাটি।
বিচারক আসন নেওয়ার পর দুই মামলাতেই চার আসামিকে সাত দিন করে রিমান্ডে চেয়ে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা সোহেল রানা।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষে পিপি আবদুল্লাহ আবু শুনানিতে জব্দ তালিকা থেকে উদ্ধৃত করে বলেন, “এগুলো ভয়াবহ মাদক। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স গ্রহণ করেছে। কিন্তু এরা ভয়ঙ্কর এসব মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকের উৎস কোথায়, কারা সরবরাহকারী, তা জানতে এদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ জরুরি।”
পরীমনির পক্ষে দাঁড়িয়ে শুনানিতে আইনজীবী নীলাঞ্জনা রিফাত বলেন, “পরীমনির ধর্ষণচেষ্টার মামলার জের ধরে তাকে এ মামলায় ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি স্বনামধন্য অভিনেত্রী। যে প্রক্রিয়ায় পরীমনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা বেআইনি। তার ক্যারিয়ার নষ্ট করার করার জন্য কুচক্রী মহল এটা করেছে।”
আরেক আইনজীবী সিকদার মো. আখতারুজ্জামান হিমেল রিমান্ড বাতিল করে জামিন চেয়ে বলেন, “যেহেতু সব আলামত উদ্ধার হয়ে গেছে বলে পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সে কারণে এখন রিমান্ডের যৌক্তিকতা কোথায়?”
হিমেল পরে চলচ্চিত্র প্রযোজক রাজের পক্ষ নিয়ে বলেন, “রাজ একজন সিআইপি ব্যবসায়ী। তার মদ পানের লাইসেন্স রয়েছে। তাদের রিমান্ড বাতিল করে জামিন দেওয়া হোক।”
উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে বিচারক দুই মামলাতেই চার আসামিকে রিমান্ডে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মেনে সাবধানে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেন।
এরপর বিচারক রাত সোয়া ৯টায় এজলাস ছেড়ে গেলে পুলিশ আসামিদের আদালত কক্ষ থেকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়।
জব্দ তালিকায় যেসব মদ ও মাদক র্যাবের করা জব্দ তালিকায় পরীমনির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ মদ এবং আইস ও এলএসডির মতো মাদকদ্রব্য উদ্ধারের কথা জানানো হয়। মাদক: চার গ্রাম আইস ও একটি স্লট এলএসডি। মদ: আটটি প্লাটিনাম লেভেল, তিনটি ব্ল্যাক লেভেল, দুটি সিগ্যাল, দুটি ফক্স গ্রোভ, একটি ব্লু লেভেল, দুটি গ্ল্যানলিভেট, একটি গ্ল্যানফিডিচ। ------------------------------------------------------------------- রাজের ফ্ল্যাট থেকে মদ ও মাদকের সঙ্গে ‘বিকৃত যৌনাচার’র জন্য ব্যবহৃত ১৪টি বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম, একটি সাউন্ড বক্সও জব্দ করা হয়। মদ: সাতটি গ্ল্যানলিভেট, দুটি গ্ল্যানফিডিচ, চারটি ফক্স গ্রোভ, একটি প্লাটিনাম লেভেল। মাদক: সিসায় ব্যবহৃত চারকোলের একটি প্যাকেট, দুই সেট সিসার সরঞ্জাম, দুই ধরনের সীমা তামাক, সিসা সেবনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের রোল, ৯৭০টি ইয়াবা। |
র্যাবের সংবাদ সম্মেলন
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, চিত্রনায়িকা পরীমনির ফ্ল্যাটে ‘মিনি বার’ ছিল। তিনি নিয়মিত মদ পান করতেন এবং ‘ঘরোয়া পার্টি’ আয়োজন করতেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “পরীমনির মদ ব্যবহারের জন্য একটি লাইসেন্স পাওয়া গেছে। তবে তার মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগে।”
মামলার দুই পাতার এজাহারে অবশ্য পরীমনির বাসায় ‘বার’ থাকার কথা বলা হয়নি। এতে বলা হয়েছে, “বেডরুমের দেওয়ালের সাথে কাঠের ফ্রেমে রক্ষিত পরীমনির দেখিয়ে দেওয়া মতে এসব মদ ও মাদক উদ্ধার করা হয়।”
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, পরীমনির চলচ্চিত্র জগতে অবস্থান তৈরিতে প্রযোজক রাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। আর চলচ্চিত্র জগতে পা দিয়েই তিনি অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন।
নড়াইলের মেয়ে শামসুন্নাহার স্মৃতি ঢাকার চলচ্চিত্রে পরীমনি নামে অভিষিক্ত হন ২০১৫ সালে। সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ তুলে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন তিনি।
রাজ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার। প্রযোজকদের সংগঠন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক ও পরিবেশক সমিতির সদস্য রাজ অভিনয়ও করেন।
র্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, “পরীমনির বাসায় মিনিবারকে ঘিরে যে সব পার্টি হত, সেখানে অ্যালকোহল সরবরাহ করত রাজসহ কয়েকজন।”
‘রাজ মাল্টিমিডিয়া’ প্রতিষ্ঠানটি ‘অনৈতিক কাজে’ ব্যবহার হত জানিয়ে তিনি বলেন, “তার কম্পিউটারে যে পর্নগ্রাফিক কনটেন্ট এবং বিকৃত যৌনাচারের যে আলামত পাওয়া গেছে, সেগুলো সে কোন কাজে লাগাত, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।”
এর আগে মঙ্গলবার ‘ডিজে পার্টি’ আয়োজনের আড়ালে অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শরিফুল হাসান (মিশু হাসান) ও মাসুদুল ইসলাম ওরফে জিসান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাদের তথ্যের ভিত্তিতেই পরীমনি ও রাজের বাড়িতে অভিযান চলে বলে কমান্ডার আল মঈন জানান।
তিনি বলেন, “মিশু হাসান ও জিসানের সহযোগিতায় ১০-১২ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে রাজ। এই সিন্ডিকেট রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে থাকে।”
র্যাব মুখপাত্র বলেন, “এসব পার্টি শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও হয়ে থাকে। পার্টিতে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকেন। এসব অবৈধ অর্থ রাজ ঠিকাদারি ব্যবসা ছাড়াও শোবিজ জগতে ব্যবহার করতেন।”
এসব ব্যবসায় অর্থ জোগানদাতা কয়েকজন সম্পর্কে রাজ তথ্য দিয়েছেন জানিয়ে আল মঈন বলেন, “তার দেওয়া তথ্য আমরা যাচাই করে দেখছি।”