হাসেম ফুডসে আগুনে পোড়া ১৩ জনই ছিল শিশু শ্রমিক

নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ১৩ জনই ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক। কয়েকজনের বয়স ১৮ হলেও তারা শিশু বয়স থেকেই ওই কারখানায় কাজ করছিল বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।

কামাল হোসেন তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 August 2021, 03:00 PM
Updated : 4 August 2021, 06:03 PM

ওই কারখানায় পুড়ে যাওয়া ৪৮টি মৃতদেহের ডিএনএ পরীক্ষা করে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি তিনটি লাশেরও ডিএনএ পরীক্ষার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি।

এর মধ্যে বুধবার ২৪ জনের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রোমানা আক্তার বলেন, ৪৮টি নমুনার মধ্যে যে ৪৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের ৩০ জন নারী ও ১৫ জন পুরুষ।

গত ৮ জুলাই হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ওই ঘটনায় অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজনের লাশ তখনই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

বাকি লাশগুলো এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে চোখে দেখে সেগুলো শনাক্ত করার উপায় ছিল না। ফলে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় শনাক্তের জন্য লাশগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।

সিআইডি জানিয়েছে, ৪৮ জনের মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য স্বজনদের ৬৮ জনের কাছ থেকে তারা নমুনা সংগ্রহ করেছে। ৪৮ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩১ জনই নারী, বাকি ১৭ জন পুরুষ।

স্বজনরা সিআইডিকে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে ওই ৪৮ জনের মধ্য ১৩ জনের বয়স ১৮ পার হয়নি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী হাসনাইনের বয়স ১২ বছর, তার বাড়ি ভোলায়।

ঢাকা মেডিকেলে লাশ নিতে আসা আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সাগরিকা সায়লার বাবা স্বপন মিয়া জানান, তিন বছর আগে ওই কারখানায় চাকরি শুরু করেছিল তার মেয়ে, তখন তার বয়স ছিল ১৪ বছর।

স্বজনদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই কারখানায় অনেক শ্রমিকের বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর হলেও তাদের ১৮ বছর দেখানো হয়েছে।

শনাক্ত ৪৫টি মৃতদেহের মধ্যে ২৪ জনের লাশ বুধবার পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সিআইডি অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, “বাকি মৃতদেহ শনিবার হস্তান্তর করা হবে।”

বুধবার যাদের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয় তারা হলেন- নোয়াখালীর এনায়েত হোসেনের ছেলে মো. আয়াত হোসেন (১৯), একই জেলার আবুল কাসেমের ছেলে রাশেদ (২৫) এবং বাশারের ছেলে তারেক জিয়া (১৫)।

কিশোরগঞ্জের নিজাম উদ্দিনের মেয়ে সাহানা আক্তার (১৮), একই জেলার খোকনের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৩৮) ও ঝর্না আক্তারের মেয়ে ফারজানা (১৪), সুজনের মেয়ে ফাতেমা আক্তার (১৫), গিয়াস উদ্দিনের ছেলে মুন্না (১৬), স্বপন মিয়ার মেয়ে সাগরিকা সায়লা (১৭)।

এছাড়া কিশোরগঞ্জ জেলার তাহের উদ্দিনের ছেলে নাঈম ইসলাম (১৬), আব্দুল কাইয়ুমের মেয়ে খাদিজা আক্তার (১৬), মাহতাব উদ্দিনের স্ত্রী সাহানা আক্তারের (৪৪) মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে আগুনে পোড়া হাসেম ফুডস কারখানা থেকে হতভাগ্য শ্রমিকদের লাশ বের করে আনছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

নারায়ণগঞ্জের বেলাল হোসেনের মেয়ে মিতু আক্তার (১৭), একই জেলার সুমাইয়া আক্তারের মা ফিরোজার (৩৬) মৃতদেহ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।  

নরসিংদীর জসিম উদ্দিনের মেয়ে রিয়া আক্তার (৩০), গাইবান্ধার হাসানুজ্জামানের মেয়ে নুসরাত জাহান টুকটুকি, নেত্রকোণার কবির মিয়ার মেয়ে হিমা আক্তার, পাবনার শাহাদত খানের ছেলে মোহাম্মদ আলী, গাজীপুরের লিলি বেগমের ছেলে রিপন মিয়ার (১৭) মৃহদেহ হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়া নেত্রকোণার আজমত আলীর মেয়ে তাকিয়া আক্তার, বগুড়ার নয়ন মিয়ার মেয়ে নাজমা খাতুন, হবিগঞ্জের আব্দুল মান্নানের মেয়ে ইসরাত জাহান তুলী, ডেমরার নাজমুল হোসেনের মা নাজমা বেগম (৩৫), ভোলার কবির হোসেনের ছেলে রাকিব হোসেনের (১৭) লাশ বুঝে পেয়েছেন স্বজনরা।  

নারায়ণগঞ্জে আগুনে পোড়া মৃতদেহগুলো নিতে বুধবার মর্গে ২৪টি অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়। শাহবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহফুজুর রহমান বলেন, “পর্যায়ক্রমে সারিবদ্ধভাবে অ্যাম্বুলেন্সগুলো রেখে মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়।”

নিহত শ্রমিকদের মধ্যে ১৮ জনই কিশোরগঞ্জ জেলার, ভোলার রয়েছে ৫ জন, নোয়াখালীর ৪ জন, নেত্রকোণা ও হবিগঞ্জের ৩ জন করে, নারায়ণগঞ্জ ও গাইবান্ধার ২ জন করে আর মৌলভীবাজার, গাজীপুর, রাজশাহী, নরসিংদী, পাবনা, দিনাজপুর, জামালপুর, ঢাকা, নীলফামারী, বগুড়া ও বরিশাল জেলার একজন করে শ্রমিক রয়েছে।

শনাক্ত বাকি ২১ জন হলেন
মিনা খাতুন (১৪), রহিমা (৩৯), মাহমুদা আক্তার (২২), রাবেয়া আক্তার, নাজমুল হোসেন, সেলিনা আক্তার,তাসলিমা আক্তার, ফাকিয়া আক্তার, রহিমা আক্তার, আমেনা আক্তার (২২), হাসনাইন (১২), শামীম (১৭), আকাশ মিয়া, সান্তা মনি আক্তার (১৪), অমৃতা বেগম (৩৬), শেফালী রানী সরকার (১৭), কল্পনা রানী বর্মন, মাহবুবুর রহমান (২৮), জিহাদ রানা, স্বপন মিয়া ও মো. নোমান (১৮)।
এছাড়া দিনাজপুরের ফয়জুল ইসলামের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের লাল্টু মিয়ার মেয়ে লাবণ্য আক্তার, ভোলার চরফ্যাশনের রাকিব দেওয়ান নিখোঁজের লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি। ভোলার মহিউদ্দিন নামেও একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্বজনদের ভাষ্য।

হাসেম ফুডসে আগুন লাগার প্রায় ২০ ঘণ্টা পর ওই কারখানা থেকে মোট ৪৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। সেসব দেহাবশেষ তারা ৪৮টি বডি ব্যাগে ভরে পাঠিয়েছিল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।

কিন্তু সেখানে পুলিশ ৪৮টি ব্যাগে ৪৮ জনের মরদেহ ধরে নিয়ে সেভাবেই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করে।

এখনও যেহেতু চারজনের লাশের দাবি করছেন স্বজনরা, নেহেতু পোড়া লাশ ৪৯টিই ছিল কি না জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রোমানা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সিআইডি ৪৮টি ব্যাগে ৪৮ মৃতদেহের পরীক্ষা করছে। ৪৫ জন শনাক্ত হয়েছে আর বাকি তিনটি রয়েছে। তবে দাবিদার কতজন তা আমরা বলছি না।

“আমরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে কাজ করছি। ডিএনএ পরীক্ষা করব এবং নমুনার সঙ্গে যাদের মৃতদেহ মিলবে, সেসব স্বজনের মৃতদেহ হস্তান্তর করা হবে।"

পুরনো খবর