‘লকডাউন আবার ফ্যাক্টরিও খোলা, আমরা কী করব’

মহামারী নিয়ন্ত্রণের লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ায় কর্মস্থলে ফিরতে বড় বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হচ্ছে পোশাককর্মীদের।

ইলিয়াস আহমেদরিপন চন্দ্র রায়, ইসরাইল হোসেন বাবু ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2021, 07:28 AM
Updated : 31 July 2021, 12:06 PM

পথের দুর্ভোগ নিয়ে শনিবার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরমুখী এসব পোশাককর্মীরা বলছেন, একে চাকরি হারানোর ভয়, অন্য দিকে পথে কিছু নেই। তাদের বিপদ দুই দিকেই।

বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের অধিকাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এই শিল্প মূলত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর কেন্দ্রিক হলেও প্রায় অর্ধ কোটি শ্রমিক ছড়িয়ে আছে সারাদেশে।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় ঈদের পর যে লকডাউন শুরু হয়েছে, তাতে সব শিল্প কারখানাও ৫ অগাস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে সরকারই জানিয়েছিল।

ফলে যেসব শ্রমিক ঈদের ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিলেন, তারা ধরেই নিয়েছিলেন লকডাউনে আর ফিরতে হচ্ছে না তাদের।

কিন্তু ব্যবসায়ীদের বারবার অনুরোধে শুক্রবার সরকার জানায়, রপ্তানিমুখী কারখানা রোববার থেকে লকডাউনের আওতামুক্ত। অর্থাৎ রোববার থেকে গার্মেন্ট খোলা।

এই সিদ্ধান্ত জানার পর শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে পোশাককর্মীরা ঢাকায় রওনা হয়, যদিও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কোনো বাস নেই সড়কে।

পদ্মা পারে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে সকাল থেকেই ভিড় ছিল।

গণপরিবহন বন্ধ থাকায় তিন চাকার বিভিন্ন গাড়ি ও মোটর সাইকেলে করে অনেককে বাংলাবাজার ঘাটে আসতে দেখা যায়। সেখান থেকে ফেরিতে উঠছিলেন তারা।

বিআইডব্লিউটিসির বাংলাবাজার ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রোববার থেকে গার্মেন্টস ও কলকারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ফলে হাজার হাজার যাত্রী।

লকডাউনে লঞ্চ ও স্পিটবোট চলাচলও বন্ধ। ফলে যাত্রীরা গাদাগাদি করেই ফেরিতেই উঠছিলেন।

বরিশাল থেকে আসা শাহাদাত হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার গার্মেন্ট খুলবে। ফ্যাক্টরিতে যেতেই হবে।”

শস্তা শ্রমের বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে চাকরির নিশ্চয়তা নেই বললেই চলে।

শাহাদাত বলেন, “অনেক কষ্ট করে এসেছি। সরকার যদি গণপরিবহন ও লঞ্চ খুলে দিত, তাহলে এত ভোগান্তি হত না।”

ইতি নামে এক গার্মেন্টস কর্মী বলেন, “আমরা গরিব মানুষ। পেটের দায়ে যেতে হচ্ছে। একদিকে লকডাউন, আবার ফ্যাক্টরিও খোলা। আমরা কী করব?

“আমরা পড়েছি ভোগান্তিতে। এক টাকার ভাড়া ১০ টাকা দিতে হচ্ছে। সরকার আমাদের জন্য কিছু করছে না।”

কিছু না পেয়ে অনেকে কভার্ড ভ্যানেও উঠে পড়ছিলেন।

ফেরিতে পদ্মা পার হওয়ার পর আবার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকায় যেতে অনেককে কভার্ডভ্যান ও নসিমনে উঠতে দেখা যায়। ভাড়া বেশি চাইছে বলে অনেককে হেঁটেই রওনা হতে দেখা যায়।

উত্তরের পথে সিরাজগঞ্জেও একই চিত্র।

বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি মোসাদ্দেক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মানুষ মৃত্যুর ভয় না করে চাকরি বাচাঁতে ঢাকায় ছুটছে।”

শনিবার সকাল থেকে হাটিকুমরুল, পাঁচলিয়া, কড্ডার মোড় থেকে নানা যানবাহনে গাদাগাদি করে ঢাকার দিকে ছুটতে দেখা যাচ্ছে মানুষকে।

ট্রাকে চেপে বসা পোশাককর্মী শিফাত আহম্মেদ বলেন, “কোরবানির ঈদ করতে বাড়ি এসেছিলাম। রোববার থেকে গার্মেন্টস খুলবে। তাই ঢাকায় যাচ্ছি।”

জুলমাত হোসেন নামে আরেক জন বলেন, ট্রাকে চান্দরা পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছে ৬০০ টাকা। সেখান থেকে প্রাইভেটকার বা মাইক্রোবাসে যেতে আরও ৪ শত টাকা ভাড়া দিতে হবে।

“খরচ বেশি হলেও ফিরতে তো হবে। নইলে চাকরি থাকবে না,” বলেন তিনি।

পোশাককর্মী জোসনা খাতুন ‘চাকরি রক্ষায়’ শিশু সন্তান নিয়ে পিকআপভ্যানে চড়েছেন।

“ভাড়াও বেশি, চরম ভোগান্তিও পোহাতে হচ্ছে। তবুও কী আর করা,” বলেন তিনি।

বাস নেই বলে সিরাজগঞ্জ থেকে চেপেছেন পিকআপভ্যানে, যেতে হবে ঢাকা।

শ্রমিকদের ঢলে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কেও চাপ দেখা যায়। নগরীর বাইপাস ও পাটগুদাম ব্রিজে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ বাইপাস মোড় থেকে শম্ভুগঞ্জ মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট।

যানজটে আটকে থাকা ট্রাক-পিককাপগুলোতে গাদাগাদি করে উঠেছে মানুষ। কেউ কেউ অটোরিকশায় চড়েছেন, আবার যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই কেউ কেউ রওনা হয়েছে ঢাকার পথে।

পারভীন বেগম নামে এক নারী বলেন, ভোরে শেরপুরের নালিতাবাড়ি থেকে বের হয়ে ময়মনসিংহ আসতে দুপুর ১২টা বেজেছে। ভেঙে ভেঙে অটোরিকশায় আসতে তার ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে।

এখন বাইপাস থেকে গাড়ি না পেয়ে অটোরিকশায় উঠছেন পারভীন।

তিনি বলেন, “এটায় ভালুকা যাব। ভাড়া দিতে হবে ২০০ টাকা। পরে ভালুকা থেকে অন্য কোনো উপায়ে গাজীপুর যাব।

“সরকার শ্রমিকদের কথা চিন্তা না করে এই সময়ে গার্মেন্টস খুলে ঠিক করেনি।”

হোসনে আরা নামে এক পোশাককর্মী পিকআপ ভ্যানে ৬০০ টাকায় ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “এমন চাকরি করার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। গরিবের কোথাও শান্তি নেই। আমাদের নিয়ে সবাই রাজনীতি করে।”

গত বছর মহামারী শুরুর পর লকডাউনে কারখানা খোলার খবরে অনেক পোশাক শ্রমিককে মাইলের পর মাইল হেঁটে ঢাকায় আসতে দেখা গিয়েছিল। পরে কারখানা না খোলায় তাদের আবার হেঁটেই ফিরতে হয়েছিল।

এবার কারখানা চালুর সিদ্ধান্তের পর শ্রমিকদের বিষয়ে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুখ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধিকাংশ কারখানার শ্রমিক কারখানার আশপাশে অবস্থান করছেন। আপাতত তাদেরকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হবে। এর মধ্যে যারা বাড়ি চলে গেছেন, এসব শ্রমিক যদি আসতে পারেন তাহলে চলে আসবেন।”

লকডাউন শিথিল হওয়ার পর দূরের শ্রমিকরা চলে আসবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এই কয়েকদিনের জন্য কারও চাকরি যাবে না, বেতন কাটা যাবে না। তবে সম্ভব হলে শ্রমিকরা অবশ্যই ফ্যাক্টরিতে চলে আসবেন।”